ইগোর কাছেই কি হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:১২
বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে অবস্থান তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মাশরাফি-সাকিব- তামিম-মাহমুদুল্লাহ-মুশফিকদের মাধ্যমে গড়ে উঠা সুন্দর সাজানো গোছানো দল। বলা যায় একটি পরিবার। বাংলাদেশ ক্রিকেট স্তম্ভের পঞ্চপাণ্ডবও বলা হয়। নানান সব ম্যাচে বিভিন্ন রকম ইনিংস খেলে দলকে যেমন নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায় ঠিক তেমনি নিজেদের জায়গা এবং পারফর্মেন্সকে করেছে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ।
কিন্তু সবকিছুর শুরু যেমন আছে, তার শেষও আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পঞ্চম পান্ডবও এর ব্যতিক্রম নয়। সব দলের খেলোয়াড়রা চায় তার বিদায় ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাঙ্গিয়ে রাখতে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের বেলায় সেই রীতি পালন হয় অন্যভাবে। আর সেই রীতি হলো তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মাধ্যমে। যার শুরুটা মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দিয়ে শুরু। এরপর ক্রমশ তা গড়িয়েছে সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ পর্যন্ত।
কিন্তু তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ব্যাপারের মধ্যেও তৎকালীন সাকিব- তামিম দ্বন্দ্বের বিষয়টি ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো। একে অপরকে দোষারোপ, অপরাজনীতি এবং মধ্যস্থতার অভাবেই দু’জনেই আজ একে অপরের দ্বিমুখী।
কিন্তু সাকিব তামিমের এই বিষয়টির জন্য অনেকটাই বিসিবির বোর্ড কর্মকর্তাগণরায় দায়ী। বরং তারা তাদের মধ্যকার বিষয়টি মধ্যস্থতার দিকে না এগিয়ে তারা অবহেলা ও উদাসীনতার প্রমাণ দিয়েছে। ঘটনাগুলোর একবার পুনরাবৃত্তি করে দেখা যাক।
মাশরাফি বিন মর্তুজার লম্বা নেতৃত্বের অবসানের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় ওপেনার তামিম ইকবালের হাতে। তামিম ইকবালও তার পুরোনো সতীর্থ প্রাক্তন অধিনায়কের পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছিলো।
তামিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বেশকিছু সাফল্য অর্জন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি অর্জন সাউথ আফ্রিকার দেশে তাদের বিপক্ষে সিরিজ জয়, অন্যদিকে ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা হিসেবে ৩য় স্থান লাভ করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভক্ত অনুরাগীরাও স্বপ্ন দেখতে থাকে তামিমের নেতৃত্বাধীন হয়তো বাংলাদেশ বিশ্বকাপের মঞ্চে ভালো কিছু করে দেখাবে। কিন্তু আফগানিস্তান সিরিজ থেকে শুরু হয় বিপত্তি।
ইনজুরি নিয়েই আফগানিস্তান ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামে তামিম ইকবাল। কিন্তু ফিটনেস, ফর্ম, ইনজুরি নিয়ে কিছুটা আপত্তি বোর্ড কর্তাদের মধ্যে ছিল। শেষ দিকে প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এবং বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের হস্তক্ষেপই অভিমানেই অধিনায়ক থেকে শুরু করে পুরো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তামিম ইকবাল। অবশ্য পরে তৎকালীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে আবার পুনরায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে ফিরে আসে তামিম ইকবাল।
অবসর থেকে ফিরে আসলেও মাসখানেক বিরতির পর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামে। কিন্তু বিশ্বকাপে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেই বিশ্বকাপ থেকে নিজের প্রত্যাহার করে নেন তামিম ইকবাল। নিজের নাম প্রত্যাহার করার কারণ হিসেবে তিনি এই মর্মে বিবৃতি রাখেন, ক্রিকেট বোর্ডের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নিষেধ করে, সেইসাথে তিনি যদি প্রথম ম্যাচে খেলতে চায় তাহলে তাকে ওপেনিংয়ের পরিবর্তে নিচের দিকে খেলার জন্য পরামর্শ দেয়।
তার এই কথার ভিত্তিতে তৎকালীন সময়ের বোর্ড নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যেহেতু বিশ্বকাপে অনেকগুলো ম্যাচ আছে, তাই মেডিকেল টিমের সাথে ও বোর্ডের সবার সাথে আলোচনা করেই তামিমের ইনজুরি কথা মাথায় রেখে দলের প্রয়োজনে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে তারা চাননি। তাই তারা তামিমকে দলে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।’
শুধু ইনজুরির দোহাই দিয়ে বিশ্বকাপের দলে না রাখার পাশাপাশি সাকিবের সাথে সম্পর্ক ভঙ্গেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর নেপথ্যে নায়ক ছিলেন তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাতরুসিংহে। জুনিয়র ক্রিকেটারদের সিনিয়রদের উপর একে অপরের দিকে মুখোমুখি করে দেওয়া, একে অপরকে আরেকজনের অনুসারী করে দেওয়া, দলের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করেই সম্পর্কের অবনতি হয় তামিম সাকিবের।
অবস্থা এমন গিয়ে দাঁড়ায় বিশ্বকাপে তামিমের না থাকা নিয়ে যখন ফেইসবুক লাইভে এসে তামিম তার মন্তব্য উপস্থাপন করে, তার এই মন্তব্যগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সাকিব আল হাসান একটি সাক্ষাৎকারে তামিমের এই অবস্থানকে ‘বাচ্চামি’ সম্বোধন করে বসে। এতে করে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি যে বেশ ভালোভাবেই হয়েছে তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এমনকি বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে নেদারল্যান্ডের মতো দলের কাছে হারা থেকে শুরু করে অনেক বড় ম্যাচেও লজ্জাজনক হারের শিকার হয় বাংলাদেশ। এর পিছনে তৎকালীন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তামিম ও তার ভক্ত অনুরাগীদের অনেকটা দায়ী মনে করেন।
এখানে যে বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে ফুটে এসেছে তা হলো ইগো বা অন্তকোন্দল। একটি দলের মধ্যে মধ্যকার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল বিষয় হলো সমঝোতা। যদি সমঝোতায় না থাকে তাহলে একটি দলের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, মনমালিন্য তৈরি হতে বেশ সময় লাগে না।
ঠিক তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে ইগো বিষয়টিও ত্যাগ করতে হয়। কারণ ইগো অনেক সময় সম্পর্ক থেকে শুরু করে কর্মজীবনেও দুঃসময় টেনে নিয়ে আসে। যার উদাহরণ তামিম-সাকিব সম্পর্কের অবনতি। আর এখানেই ইগোর কাছেই হেরে গিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এখানেই শেষ নয়, পিছনে ফিরে তাকালে মাশরাফি, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমূহতেও বিসিবির কর্মকর্তাগণদের আত্মকেন্দ্রিক ইগোর সমস্যায় বারবার ফুটে এসেছে। শুরুটা মাশরাফিকে দিয়ে শুরু করা যাক।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে মাশরাফির বিদায় জানানোর আলোচনার শুরু ২০১৬-এর জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজ চলাকালে। তখন থেকেই গুঞ্জন উঠেছিল, ভারতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর তিনি আর ২০ ওভারের ক্রিকেট খেলবেন না। বিশ্বকাপ পেরিয়ে গেলেও অধিনায়ক হিসেবে টি টুয়েন্টি খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন মাশরাফি। কিন্তু একই বছর নিউজিল্যান্ড সফরে গেলে বিষয়টি আবার উঠে আসে। কিন্তু মাশরাফি তখনও বিষয়টি এড়িয়ে যায়।
কিন্তু ২০১৭ সালেই শ্রীলঙ্কায় সিরিজ চলাকালীন আন্তর্জাতিক টি টুয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। মুহুর্তেই তার এই অবসরকে ঘিরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়, তখন গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠে আসে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা কি শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ছাড়তে পারলেন মাশরাফি?
কারণ খুঁজতে গিয়েই বের হয়ে আসে তৎকালীন সময়ে প্রথমবার কোচ হয়ে আসা চন্ডিকা হাথুরুসিংহের হস্তক্ষেপ। আর তাতে সঙ্গ দেন, বোর্ড কর্তৃপক্ষ। চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ভাষ্যমতে, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাশরাফিকে আর চাচ্ছেন না। বিশেষ করে, টি-টোয়েন্টির জন্য কোচের যে টিম কম্বিনেশন, সেখানে মাশরাফির জায়গা হয় না। তার বোলিংটাই নাকি হাথুরুসিংহের কাছে টি-টোয়েন্টি উপযোগী মনে হচ্ছে না। আর তাই শ্রীলঙ্কার সাথে সিরিজের পরেই জাতীয় দলে টি টুয়েন্টি খেলা ওখানেই শেষ হয়ে যায়।
এমনকি ২০১৯ বিশ্বকাপের পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিনায়ক হিসেবে নিজের শেষ ম্যাচ খেললেও খেলা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয় মাশরাফি। কিন্তু বিসিবি কর্মকর্তাগণ সেইদিকে মনোনিবেশ না করেই বরং দলের বাইরে থেকে যেতে হয় মাশরাফিকে।
অনেকটাই জোর করেই সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স উপর বিবেচনা করে ব্যক্তি সম্পর্কের চিড় ধরেই মাশরাফিকে অনেকটাই নিশ্চুপভাবেই বিদায় নিতে হয়। অথচ ২০১৪ সালের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কারিগর ছিলেন মাশরাফি। কিন্তু ব্যক্তি সম্পর্কের অবনতির কারণেই তাকেও খেসারত দিতে হয়।
মুশফিক রহিম, বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে ভারসাম্য ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও তাকেও বোর্ড কর্মকর্তাদের ইগোর কাছেই হার মানতে হয়। ২০২১ সালে, টি টুয়েন্টি ম্যাচগুলোতে তার ব্যাট তার হয়ে কথা বলছিলো না। কিন্তু কোথায় তার এই সমস্যা নিয়ে তার সাথে বসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে, তার সাথে তার ফিটনেস নিয়ে কাজ করবে তা না করেই উল্টো জোর করেই অবসর নেওয়ার দিকেই ঠেলে দেয় তৎকালীন বিসিবির প্রধানরা। সেই সময় বিসিবি প্রধানদের ভাষ্যমতে টেস্ট ম্যাচের প্রস্তুতি হিসেবে মুশফিকুর রহিম যাতে ভালো রান তুলতে পারে, টেস্টের জন্য ফিটনেস ধরে রাখতে পারে সেই হিসেবে বিশ্রাম দিয়েছে।
অথচ বিপিএল চলাকালীন এক সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুর রহিম হাসির ছলে এর হাস্যকর মন্তব্য করে বসেন, আমি কি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছি নিজের ইচ্ছায়?
একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারে যেমন লম্বা ইনিংস ও হাজারো উইকেটের মাইলফলক থাকবে ঠিক তেমনি বাজে পারফরমেন্স, ইনজুরি সমস্যাও থাকবে। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে, বিসিবির কর্মকর্তাগণদের দরকার তার সঠিক যত্ন করা এবং উত্তরণের পথ খোঁজা। কিন্তু তা না করেই বিসিবি বাঁধ সাধে তাদের হটানোর মিছিলে।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে হঠাৎই মাহমুদুল্লাহকে বিশ্রামের নামে দল থেকে ছাটাই করে তৎকালীন কোচ হাতরুসিংহে আর বিসিবির প্রধানরা। শুধু ২০২৩ সালেও নয়, টেস্ট ক্রিকেটে সাম্প্রতিক ফর্ম আর বয়সের দোহাই দিয়ে ২০২১ সালে টেস্ট ক্রিকেটে মাহমুদুল্লাহকে অবসরের জন্য প্ররোচনা দেয় বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অথচ চাইলেই তার ফর্ম এবং পারফর্ম নিয়ে বিসিবি কর্মকর্তারা তাকে সময় দিতে পারতো বা তাকে নিয়ে আলাদা কাজ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে, বরং ইগো সমস্যাকেই বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছে বিসিবি। সে বছর ব্যাটিংয়ে রিফ্লেক্স কমে যাওয়া, ফিল্ডিংয়ে নড়বড়ের দোহাই দিয়ে তাকে দলে রাখা নিয়ে শুরু হয় ভিতরকার দ্বন্দ্ব।
এরপরেই অনেকটা অভিমানেই ২০২১ সালের জুলাই মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীন অবস্থায় সতীর্থদের গার্ড অব অনার দেওয়া দেখেই বোঝার বাকি থাকে না টেস্ট থেকে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের যুগের অবসান ঘটে গেছে।
এইতো গেলো টেস্টের খবর, টেস্টের রেশ যেতে না যেতেই টি টুয়েন্টি থেকেও আচমকা বাদ পড়ে যান। ২০২১ এবং ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এশিয়া কাপের বাজে পারফরম্যান্সের জন্য সমালোচিত হন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। রিয়াদের ব্যাটিং ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণের সাথে যায় কি-না প্রশ্ন তুলেন অনেকেই। তাই তাকে ছেঁটে ফেলে দিতেও বেশি সময় নেননি বিসিবি কর্মকর্তাগণ।
এরপরের বছরের ইতিহাস অর্থাৎ ২০২৩ সালের ইতিহাস সবারই জানা। ২০২৩ সালে হঠাৎই মাহমুদুল্লাহকে বিশ্রামের নামে দল থেকে ছাটাই করে তৎকালীন কোচ হাতরুসিংহে আর বিসিবির প্রধানরা। এরপরেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে তৎকালীন বাংলাদেশের নির্বাচক প্যানেলের সদস্য হাবিবুল বাশার বলেন, দ্রুত রান তোলার পাশাপাশি স্ট্রাইক রোটেট করতে পারে মতোন ব্যাটসম্যান খুঁজছেন তাই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই মাহমুদুল্লাহই ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন।
বর্তমানে বোর্ড কর্মকর্তাদের আত্মকেন্দ্রিক ইগোর কাজ করার পিছনে আরো একটি বড় সমস্যা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটুক্তির উপর প্রভাবিত হওয়া।খেলোয়াড়রা ম্যাচে খারাপ পারফর্ম করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা, ট্রল বা অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়।
অনেক সময় বোর্ড কর্মকর্তাদের নামেও অনেক মিম ও ট্রল হয়, যার ফলে বোর্ড কর্মকর্তাগণদের আত্মবিশ্বাসে ধস নামায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসে।তাছাড়াও খেলোয়াড়দের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অতিরিক্ত আগ্রহ এবং গুজব ছড়ানো হয়।
এর থেকেই সৃষ্টি হয় টিমমেটদের মধ্যে বিবাদ,গ্ৰুপিং সিস্টেম এবং বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধ। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সেইসাথে তাদের চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় উক্ত খেলোয়াড়কে মাঠে নামালে দলের নাম খারাপ হতে বাধ্য।
যার ফলে তারা বিষয়টি আত্মকেন্দ্রিক ইগোতে বিষয়টি নিয়ে ফেলে। যার খেসারত স্বরূপ খেলোয়াড়দের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জোর করে টিম থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং অবসরের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
তাছাড়াও খেলোয়াড়দের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতেও তৎকালীন বিসিবি প্রধান থেকে শুরু করে বর্তমান কর্মকর্তাগণ ছিলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তামিম-সাকিব দ্বন্দ্বের দিকে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। বোর্ড চাইলেই তামিম সাকিবের দ্বন্দ্বটি নিমিষেই দূর করে দিতে পারতেন, দুজনের মধ্যে মধ্যস্ততা সম্পন্ন সম্পর্ক গড়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার কথায় ধরা যাক। ভারতের প্রাক্তন ফিল্ডিং কোচ শ্রীধর তার আত্মজীবনী বই ‘কোচিং বিয়ন্ড’- এ রোহিত- কোহলির দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরেন।
২০১৯ বিশ্বকাপের শুরুর আগে রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করে। তা আরো সম্পূর্ণ জোড়ালো হয় ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। সেইবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই দুই তারকাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা, সমালোচনা হয়। এতে করে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ড্রেসিংরুমে।
দলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তৎকালীন সময়ের কোচ রবি শাস্ত্রী, তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। বিশ্বকাপের পর যখন ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি টুয়েন্টি সিরিজ খেলতে যায়, সেখানে ড্রেসিংরুমে বসেই রবি শাস্ত্রী রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলিকে ডেকে বসান। তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন ‘নেটমাধ্যমে যা হয়েছে , তা হয়ে গিয়েছে। তোমরা দলের সব থেকে সিনিয়র ক্রিকেটার। দলের মধ্যে এই ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে। আমাদের এগোতে হলে তোমাদের এক হতে হবে।’ রবির এই বার্তাই পাল্টে দিয়েছিল রোহিত, বিরাটের সম্পর্ক। কিন্তু বিসিবি কর্মকর্তারা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং তাদের সম্পর্কের অবনতিটাই উপভোগ করে গিয়েছেন এবং আত্মকেন্দ্রিক ইগোকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে এবং তাদের ও কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। এবং বোর্ড কর্মকর্তাদের অনেক বিষয় তাদের পছন্দ নাও হতে পারে, বরং খেলোয়াড়দের সাথে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইগোর দিকে না আগানোয় হলো বুদ্ধিমানের কাজ।বরং তা সবার মাঝে মধ্যস্থতা করে সম্পর্ক গুছিয়ে দিতে পারতো, যা থেকে বিসিবি কর্মকর্তাগণ অনেকাংশে পিছিয়ে। যার ফলে মাশরাফি থেকে শুরু করে তামিম, মুশফিক মাহমুদুল্লাহরা অবসরের পথকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেউ হয়তো নিজ মাঠে অবসর নিয়েছে আর অন্যরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে।
সাম্প্রতিক সময়ে তামিমের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা হয়তো একটু পরিবর্তন করে দেশের হয়ে খেলে রাজকীয় বিদায় নিতে পারতো। উদাহরণস্বরূপ ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কাকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার পর বিশ্বকাপ থেকেই অবসর নেন কুমার সাঙ্গাকারা। তামিম ইকবাল চাইলেও একই পদ্ধতিতেই এগোতে পারতো, হয়তো তার থেকে আরো লম্বা ইনিংসের আশা করা যেতো।
যদিও এর মাঝখানে অন্য যৌক্তিকতাও আছে।তামিমের পরিবর্তি সময় থেকে কতো ওপেনার এলো গেলো, এখনো তামিমের জায়গাটি কেউ রপ্ত করতে পারলো না। সাম্প্রতিক সময়ে দলের টপ অর্ডাররা রান তুলতে ব্যর্থ হয়, সেইসাথে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো আসরে টপ অর্ডারের কথা চিন্তা করে তামিমকে ফেরানোর কথা চিন্তা করে বোর্ড।
এর অন্যভাবে চিন্তা করলে নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে তামিমকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতেও তারা একবারও ভাবেননি। শুধুমাত্র নিজেদের ইগো আর স্বার্থের কথা না ভেবে যদি দলের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যত তরুণ খেলোয়াড়দের গড়ে তোলার কথা ভাবতো তাহলে দর্শক আরো একবার জাতীয় দলে তামিমের ব্যাটিং উপভোগ করতে পারতো। তাই নিঃসন্দেহে তামিম তার যৌক্তিক জায়গা থেকে অবশ্যই সঠিক কাজের দিকে এগিয়েছেন।
কিন্তু তৎকালীন থেকে শুরু করে বর্তমান বোর্ড মালিকগণদের ইগোর সমস্যা এবং উদাসীনতার জন্যই বরং দ্বন্দ্বের প্রভাবটাই বেড়েছে।যার ফলে শেষবারের মতো তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর জুটি থেকে চির বঞ্চিত হতেই হলো ভক্ত অনুরাগীদের।
খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বোর্ড নির্বাচকদের মাঝেও চলছে ইগোর দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি বিসিবির সভাপতি ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন ফাহিম। তার ভাষ্যমতে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। এরই মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যায় বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খেলাধুলা উন্নতির চাইতেও নিজেদের মধ্যে ইগো, দ্বন্দ্বকেই সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে ব্যস্ত।
সময়ের পরিবর্তনে বাংলাদেশ আজ তরুণ প্রজন্মের অধীনে বিশ্বমঞ্চে খেলছে। পঞ্চ পাণ্ডবদের অধ্যায়ের পর দলের দায়িত্বের ভার এখন নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে। টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পর আইসিসির আরো একটি ইভেন্ট ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি’ প্রতিনিধিত্ব করবে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। কারণ তারাই আগামী দিনের তামিম-সাকিব-মাশরাফি।
কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ দলে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে করে প্রশ্ন উঠতেই পারে অদূর ভবিষ্যতে নাজমুল হোসেন শান্ত, মেহেদী মিরাজ, তাসকিন আহমেদের খেলোয়াড়রা পূর্বের খেলোয়াড়দের মতোন অপমানের স্বীকার হবে কি- না!
প্রত্যেক খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে তাদের শেষটা যেনো বর্ণিল সাজে শেষ হয়, কিন্তু সেই বর্ণিল সাজের পরিবর্তে যদি অপমানই যদি জোটে তাহলে ভবিষ্যৎ খেলোয়াড়দের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তাই সময় থাকতেই বর্তমান বোর্ড কর্মকর্তাদের নিজের মধ্যে থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের মধ্যে ইগো দূরীকরণ করতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক পেশাদার, সম্মানজনক এবং সহযোগিতামূলক ভাবভঙ্গি তৈরি করতে হবে। যাতে করে একটি সুস্থ এবং কার্যকর ক্রীড়া পরিবেশ তৈরি হয়।
অনেক সময় মানুষের মাধ্যমে যা ঘটে অনেক সময় তা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু বিষয়টিতে একজন ব্যক্তি হিসেবে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা পুরোটাই মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ায় ইতিবাচকতা আনার কারণে অনেক নেতিবাচক ঘটনার প্রভাবও কমে আসে।
আর তাই খেলোয়াড় এবং বোর্ড কর্মকর্তাদের উভয়ের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে এবং মতপার্থক্য থাকলেও তা শালীন এবং গঠনমূলক উপায়ে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে।
খেলোয়াড়দের বাজে পারফরমেন্সের সময় তা নিয়ে তাদের সাথে সহমর্মিতাস্বরুপ আলোচনা করতে হবে ।গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে তা যেন খেলোয়াড়দের উন্নতির পথ দেখায়।সিনিয়র হোক কিংবা জুনিয়র বোর্ড কর্মকর্তাদের উচিত তাদের সামর্থ্যে বিশ্বাস রেখে ভবিষ্যতে ভালো করার জন্য উৎসাহিত করা। সেইসাথে দোষারোপের পরিবর্তে তাদের শক্তি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া উচিত।
খেলোয়াড়দের সাথে বোর্ডের কর্মকর্তাদের খোলামেলা এবং স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করা উচিত। তাদের সমস্যাগুলো শোনা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সমাধান করা গুরুত্বপূর্ণ।ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এতে বোর্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং খেলোয়াড়দের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।খেলোয়াড়দেরও বোর্ডের নিয়ম-নীতি এবং চুক্তি মেনে চলা উচিত।এতে করে উভয় পক্ষই একটি টিম হিসেবে কাজ করলে ক্রিকেটের মান উন্নত হবে।
পাশাপাশি বোর্ড কর্মকর্তাদেরও নিজেদের ইগো সমস্যা উত্তরণে মনোযোগী হতে হবে। বোর্ড পরিচালনায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে পেশাদারিত্ব এবং সুশৃঙ্খল কার্যপ্রণালীতে জোর দিতে হবে। নিয়ম-নীতি মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি। বোর্ড মিটিংগুলোতে সবার মতামত গুরুত্ব সহকারে শোনা এবং তা নিয়ে আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মতের পার্থক্য থাকলেও তা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বোর্ডের দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত স্বার্থকে বাদ দিয়ে দেশের ক্রিকেট এবং খেলোয়াড়দের উন্নতির জন্য কাজ করা উচিত এবং ভুল বোঝাবুঝি ও ইগো সমস্যা কমাতে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং বোঝাপড়া আরও শক্তিশালী করতে হবে।
সর্বোপরি, সম্পর্কটি যদি সম্মান এবং বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়, তবে এটি পুরো ক্রিকেট দলের এবং দেশের জন্যই উপকারী হবে।আর না হলে ইগো সমস্যার জন্য দেশের ক্রিকেটের নাম খারাপের পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের খেলোয়াড়দের বাংলাদেশ ক্রিকেটে খেলার আগ্রহ কমে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি