Wednesday 22 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেমিট্যান্স যোদ্ধা: দেশের রিয়েল হিরোদের নিরাপত্তা ও সম্মান

তৌহিদ-উল বারী
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪০

দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাটুকু রাখার যে দাবি করি তার বেশিরভাগই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদেরই অবদান। এটি যেমন নিঃসন্দেহে সত্য তার চেয়েও চরম সত্য যে দেশে তাদের যথাযথ নিরাপত্তার পরিবেশ না থাকার বিষয়টি। অথচ এরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, পরিবার পরিজন ছেড়ে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিকে সচল রাখতে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে সর্বদা।

রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আমাদের গর্ব। তারা তাদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে আমাদের অর্থনীতির ভিত শক্ত করে যাচ্ছে দিনকে দিন। কিন্তু যারা অর্থনীতির চাকায় জ্বালানি জোগান, প্রকৃতপক্ষে আমরা কি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারি? হয়তো যা দিই তা কেবল কাজির গরুর মতো কাগজে-কলমে, গোয়ালে নয়।

বিজ্ঞাপন

প্রবাসীরা তাদের ঘাম ঝরানো রেমিট্যান্স মাস শেষ হওয়ামাত্রই বাংলাদেশে প্রেরণ করে দেয়। হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের জন্য না ভেবে তারা তাদের পরিবার, সমাজ আর দেশের জন্য ভাবে। নিজে কিভাবে চলবে, কেমন করে দিন পার করবে তার কোনো চিন্তা তার মাথায় থাকে না। তার মাথায় কেবল পরিবারের চিন্তা। তাদের পাঠানো এসব অর্থ দেশের বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে। তার একটি রিপোর্ট বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলো দারিদ্র্য দূর করতে পারে। এতে করে একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেড়ে যায়। কেননা, রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। বলতে গেলে বেশিরভাগ প্রবাসীর পরিবার গ্রামে বসবাস করে যার প্রেক্ষিতে পাঠানো এই রেমিট্যান্স গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বাড়িয়ে তুলে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকান্ডে গতিশীলতা বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যার মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের মতো। প্রকৃতপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য। এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ আসে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশের রিজার্ভ দিনকে দিন শক্তিশালী হলেও বাজেটে তাদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ থাকে না। নগদ প্রণোদনা ছাড়া বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য নামেমাত্র যেই বাজেট আছে, তা মূলত প্রবাসীদের জন্য নয়। সেটি ব্যয় হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব খরচের খাতে। প্রবাসীদের সরাসরি উন্নয়ন খাতে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ থাকে না। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ধরে রেখেছে।

যদিওবা এত অবদান রাখার পরও দেশে তারা সবচে বেশি অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার হয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও থাকতে হয় সর্বদা শঙ্কায়। বিমানবন্দরে নানা হয়রানি, টিকিটের বাড়তি মূল্য, প্রবাসীদের নেই উন্নত চিকিৎসা, উচ্চমূল্যে ভিসার সিন্ডিকেট এবং প্রবাসীদের লাশ দেশে আনতে নানা ঝামেলা ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের। পাশাপাশি তারা পারিবারিক, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যে সমস্ত অবহেলার সম্মুখীন হয়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

সামাজিক ও মানসিক অবহেলা: প্রবাসীরা তাদের পরিবার ও সমাজের জন্য যথেষ্ট অবদান রাখলেও ব্যক্তিগত সমস্যায় তারা যথাযথ মূল্যায়ন পায় না। ফলে তারা মানসিকভাবে প্রচন্ড রকমের একাকিত্ব অনুভব করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা: অনেক প্রবাসী শ্রমিক তাদের কাজের জায়গায় সঠিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, এবং আইনি সুরক্ষা পান না। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আইনী আশ্রয় থাকা সত্বেও তারা তার যথাযথ সুবিধা পান না। এছাড়াও বিমানবন্দরে প্রবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে

রেমিট্যান্সের অবমূল্যায়ন: প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও তাদের অবদানের প্রেক্ষিতে যথেষ্ট সুযোগ বা সুবিধা দেওয়া হয় না। দেশে ফেরার পর অনেক সময় তারা অবজ্ঞা বা অবহেলার শিকার হন। এটি তাদের ব্যক্তিত্বে চরম আঘাত করে।

সরকারি সহায়তার অভাব: জরুরি পরিস্থিতিতে (যেমন—সংকটকালীন সময়ে) প্রবাসীরা অনেক সময় যথাযথ সরকারি সহায়তা বা দূতাবাসের সহযোগিতা পান না। ফলে তারা নানাধরনের হয়রানির শিকার হয়। যেটা তাদের জনজীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলে দেশের সরকারি সিস্টেমের প্রতি তাদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যেটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এসব অবহেলা থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। নিশ্চিয়তা দিতে হবে যে, পরিলক্ষিত সমস্যাগুলো সমাধান করে, প্রবাসীদের এসব দুর্ভোগ লাঘব করে তাদের ন্যায্য অধিকার যেমন—প্রবাসীদের লাশ দেশে ফ্রিতে আনার ব্যবস্থা, বিমানবন্দরে উপযুক্ত সম্মান, প্রবাসীরা দীর্ঘমেয়াদে বিদেশ থেকে দেশে আসার পর ভাতার ব্যবস্থা, প্রতারক ট্রাভেলস এজেন্সির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, বিনাশর্তে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থাসহ প্রবাসীদের কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রেমিট্যান্সের হারও বাড়বে, তারাও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে।

আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে সমস্ত পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার তা যদি নিতে না পারি তাদের প্রতি চরম বৈষম্য হবে। বৈষম্যহীন সোনার বাংলায় প্রবাসীদের প্রতি বৈষম্য কখনো কাম্য নয়। এজন্য আমাদের শ্রম অভিবাসন-সুরক্ষা ও সহযোগিতা প্রদানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের কার্যক্রমে লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি অনুসরণ করতে হবে। নারীদের অভিবাসনের হার বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলো দূতাবাসের শ্রমবিষয়ক কর্মকর্তা ও শ্রম উইং এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ওপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসনের অনন্য অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির জন্য শ্রম অভিবাসন বিষয়ক নীতিকে সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা খাতভিত্তিক ও অন্যান্য সামাজিক ও শ্রম সংশ্লিষ্ট নীতিকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত আবশ্যক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

তৌহিদ-উল বারী মুক্তমত রেমিট্যান্স যোদ্ধা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর