Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে

ড. মিহির কুমার রায়
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৫০

নতুন বছর শুরু হয়েছে এক অনিশ্চয়তার হাতছানি নিয়ে যা আমাদেরে সামাজিক ও অর্নৈতিক জীবনকে প্রতিনিয়তই বিপযস্ত করছে বিশেষত: দেশের ২কোটির বেশী মানুষকে যারা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাবে বিপুল খাদ্যনিরাপত্তায় ভুগছে। এর মধ্যে কৃষকরা এত বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগছেন এ প্রশ্নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন বলেন কৃষকরা খাদ্য সরবরাহ করেন। বিশেষ করে এখন যে উচ্চ মূল্যের কৃষিপণ্য এসেছে তারা সেগুলো উৎপাদন করে বিক্রি করে ফেলে। তারা নিজের খাবারের জন্য যা রাখেন সেগুলো খুবই সামান্য, অপুষ্টিকর। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তাদেরই বেশি হবে। যেমন তারা দুধ বিক্রি করে ফেলেন, নিজের জন্য রাখেন না। দুধ পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য রাখেন না। তারা দুধ বিক্রি করে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য কিছু কেনেন। তিনি বলেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কম। সে হিসেবে তারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারেন না। তারা যেসব শাকসবজি খায় সেগুলো একেবারেই নিম্নমানের, সব বিক্রি করার পর যা থাকে। এটি তো স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা খাদ্য সরবরাহ করলেও পুষ্টি নিয়ে তাদের শিক্ষা কম। সেজন্য তাদের খাদ্য নিরপত্তাহীনতা বেশি। তাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোট কৃষি উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর প্রভাব কৃষকদের একটি অংশের ওপর তো পড়বেই। এজন্য তাদের খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা খুব কমই উপকৃত হচ্ছেন। রাষ্ট্রের নীতি কাঠামো ও পরিকল্পনায় কৃষক, গ্রামীণ মানুষ ও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ কোনো কিছু চিন্তা করা হয়নি। তাই কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে আলাদা কোনো বিষয় নয় কেন?

বিজ্ঞাপন

মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে চাল ক্রয়ে

আমনের ভরা মৌসুম। ভারত থেকেও আমদানি হচ্ছে চাল। এতে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। তারপরও মিলারদের কারসাজিতে দামে অস্থিরতা। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে সরু চাল সর্বোচ্চ ৮৫-৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা বেড়ে মোটা চাল সর্বোচ্চ ৬০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এতে মৌসুমেও চাল কিনতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন ভোক্তা। খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৫ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগেও ৭৫ টাকা ছিল। নাজিরশাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০-৮৬ টাকা। যা আগে খুচরা পর্যায়ে ৭০-৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। যা আগে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি মাঝারি আকারের চালের মধ্যে বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগেও ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও চাল বিক্রেতা বলেন, দেশে আমনের ভরা মৌসুম চলছে। কৃষকের নতুন চাল বাজারে এসেছে। বিক্রিও হচ্ছে। সঙ্গে ভারত থেকেও আমদানি করা চাল বাজারে এসেছে। এতে বেড়েছে সরবরাহ। চাহিদার তুলনায় কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ মিল থেকে হঠাৎ করে সব ধরনের চাল ৫-১০ টাকা কেজিপ্রতি বাড়িয়েছে। যে কারণে পাইকারি বাজারে বাড়ায় খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে। তাই মিল পর্যায়ে তদারকি করা গেলে দাম কমে আসবে। এতে ভোক্তারা উপকৃত হবেন।

কেউ বলছে না কৃষকের কথা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন করে দেশ পুনর্গঠনের বিভিন্ন দাবি উঠলেও, দুঃখজনকভাবে কৃষকদের অধিকারের প্রশ্ন অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা জাতির সামনে জ্বলন্ত বাস্তবতা।সাম্প্রতিক কৃষি শুমারিতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি কৃষক প্রান্তিক কৃষক বা ভূমিহীন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে কম। তারা প্রায়ই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দারিদ্র্যের হার কৃষকদের মাঝে বেশি, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। বেশিরভাগ কৃষক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। মৌসুমের ওপর নির্ভরশীলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা প্রায়ই খাদ্যের ঘাটতির সম্মুখীন হন। আবার এবার বোরো চাষে বাদ অর্ধেক জমি, তীব্র হতে পারে খাদ্য সংকট। গত আগস্ট মাসে পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় দেশের ২৩টি জেলার ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক বন্যার কারণে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। বন্যায় সরাসরি আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর, যার কারণে কৃষিতে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চলের শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলার কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি কৃষকের জীবনের ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতিমালা কৃষকদের কল্যাণের দিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। যার প্রমাণ পাওয়া যায় কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তার ঘাতটি ও সঠিক পুনর্বাসন পরিকল্পনার অভাবে।

বিজ্ঞাপন

মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি

রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) ওপর ভর করার যে পথটি বেছে নিয়েছে, তা প্রতিকূল ফলাফল নিয়ে আসতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন। ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদশালীদের ওপর সরাসরি বাড়তি কর আরোপের পরিবর্তে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতিতে কাহিল সাধারণ মানুষের ওপর এ কৌশল চাপ আরও বাড়াবে। কারণ, পণ্য এবং সেবার দাম বাড়বে বলে এ ধরনের পরোক্ষ করের বোঝা গরিব এবং মাঝারি আয়ের মানুষদের ওপর সমানভাবে পড়বে। এটি সমাজের উচ্চমাত্রার আয়বৈষম্যকে আরও তীব্র করবে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের ধারণা, মূল্যস্ফীতির এ নতুন ধাক্কা এবং বৈষম্য বৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ অবস্থায় সরকার কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সর্বস্তরের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বর্তমানের নন-এসি হোটেল সেবার ওপর থাকা সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের দোকানের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাতে তৈরি পোশাক কেনার খরচও বাড়বে। মিষ্টির ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এসবের বাইরে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্র্যান্সফরমার, টিস্যুপেপার ইত্যাদি পণ্য এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ডের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সিন্ডিকেট কেড়ে নিল স্বস্তি

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জন্যই বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিত্যপণ্যের সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান ও পরিবহনসহ সব জায়গায় এই সিন্ডিকেটের শৃঙ্খল খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে সরকারের দুর্বলতা, অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক। এতে সাধারণ মানুষ ক্রমাগত কষ্টের মধ্যে পড়ছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রত্যাশা ছিল- এবার হয়তো ভাঙবে বাজার সিন্ডিকেট, কমবে ভোগ্যপণ্যের দাম। বর্তমান সরকারের একশ দিন পার হয়ে গেলেও দেশের সাধারণ মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের প্রথম কাজ ছিল সিন্ডিকেটের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাথমিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করসাজি বন্ধ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার আজও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষত, খাদ্য ও বাজারজাতকরণে সিন্ডিকেটের প্রভাব রয়ে গেছে এবং জনগণের চরম দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছ।

ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থার চ্যালেঞ্জ

দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা সংকটের সম্মুখীন, যেখানে ব্যাংকখাত নগদ প্রবাহ সংকট এবং অপ্রদর্শিত ঋণের চাপে ভুগছে। এই সংকটের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার বড় ধরনের অভাব দেখা দিয়েছে। সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ, আমানত প্রবৃদ্ধি ও ঋণ পুনরুদ্ধারে ধীরগতি এবং বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতে সাধারণ মানুষের অনাস্থার সৃষ্টি। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে এ সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণের উচ্চ সুদহার দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই বারবার ব্যাংক ঋণে সুদহার বৃদ্ধিতে চরম সংকটে পড়েছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে ব্যবসার প্রসার ঘটছে না। থমকে আছে বিনিয়োগ। বস্তুত ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশির ভাগ উদ্যোক্তা। বেশিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য সংকট থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা ও কৃচ্ছ সাধনে সাশ্রয়ী অর্থ ব্যয় করতে সরকার ঋণের নীতিতে পরিবর্তন আনছে।

খেলাপি ঋণ কত

বছর ব্যাপি ছিল গ্রাহকের অনাস্তা,তারল্য ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ প্রাধান্নতা। দশটি দবল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা সত্বেও দাড়াতে সক্ষম হচ্ছে না। এর মূল কারন হিসাবে দেখা হয় খেলাপি ঋনকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সংখ্যার সঙ্গে কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নেয়া ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করা হলে পরিমাণটা আরো অনেক বেশি। অনেকের মতে, এর পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত আগস্টে সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের তৃতীয় কোয়ার্টারে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

রাজস্ব আদায়ে অপারগতা

চলতি অর্থবছরের এনবিআর আওতাধীন মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৩২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭৬ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা (বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা (বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৫২ দশমিক ১ শতাংশ)। এনবিআর আওতাধীন রাজস্বের মধ্যে আয়কর খাতে ২৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে ৩০ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ও সম্পূরক শুল্ক খাতে ৯ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। অর্থ বিভাগ জানায়, রাজস্ব আদায়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তবে বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

আইএমএফের শর্তপূরণ চ্যালেঞ্জে দেশের অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিছু শর্ত বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঋণের সুদহার বাড়ানো, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করা, ডলারের দাম বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ। এতে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। সব মিলে উদ্যোক্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তারা ইতোমধ্যে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের বিপক্ষে কথা বলেছেন।

কৃষি ঋণ বিতরণে নিম্নগতি

কৃষি ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ২৭%, উৎপাদনে প্রভাব পড়বে? এই প্রশ্নটি জোরালো হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। বাকি ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করবে দেশের বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এর মধ্যে বিতরণ করতে পেরেছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। সাম্প্রতিক দুটি বন্যায় কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারেও রয়েছে অস্থিরতা। এ অবস্থায় কৃষি ঋণ বিতরণ কমে আসায় আসন্ন রবি ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও এর আগের খরার প্রভাবে এবার আরো বেশি করে কৃষি ঋণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণে জোর না দেয়ায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে কৃষি ঋণ বিতরণ কিছুটা কমেছে।

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এমন এক কঠিন সময় পার করছে, যেখানে আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি সবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বৃহত্তর ঝুঁকি হলো আস্থার অভাব এবং আর্থিক খাতে নগদ টাকার অভাব। এ অবস্থায় টাকা মুদ্রণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নয়নের সমন্বিত কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও অর্থনৈতিক অবনতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এই পন্থা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সহায়ক হবে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর