সমাজবিজ্ঞানে জুলাই বিপ্লব: শ্রেণি সংগ্রাম ও সামাজিক পরিবর্তন
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৫৪
মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাস করে। আর মানুষ সমাজে একাকী বাস করতে পারে না। সমাজ বলতে আমরা বুঝি যেখানে মানুষ বসবাস করে। আর এটি কতগুলো বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত। এখানে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সমাজের মূল ভিত্তি মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন। কারণ কেউ যদি বনে বা পাহাড়ে একাকী বাস করে তাহলে সমাজ বলা যাবে না। আর সমাজ নিয়ে অধ্যয়ন করে সমাজবিজ্ঞান। অনেক সমাজবিজ্ঞানী সমাজকে নানা ভাবে সজ্ঞায়িত করেছেন।
MacIver এবং Page বলেছেন, ‘সমাজ হলো একাধিক মানুষের সম্পর্কের জটিল নেটওয়ার্ক। এটি শুধুমাত্র মানুষ ও তাদের সম্পর্কের সমষ্টি নয়, বরং এটি তাদের কাজ, চিন্তা এবং অনুভূতির সমন্বয়।’ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক Karl Marx বলেন, ‘সমাজ হলো শ্রেণি সংগ্রামের মঞ্চ। এটি মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত, যা মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।’ Max Weber এর মতে, ‘সমাজ হলো মানুষের পারস্পরিক অর্থপূর্ণ সামাজিক ক্রিয়ার একটি ফলাফল।’ সুতরাং সমাজ মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আর সমাজ মানুষের দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে মানুষের আচার আচরণ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কৃতি ও জীবনধারণ সমাজকে প্রভাবিত করে। আর মানুষই পারে সমাজের পরিবর্তন নিয়ে আসতে। সম্প্রতি বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সমাজের মানুষের সামষ্টিক মিথস্ক্রিয়ায় ফলে। আর এমন কথা উল্লেখ করেছিলেন Karl Marx তার শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বে। বর্তমান সমাজ পুঁজিবাদ নির্ভর। আর এই সুযোগে ধনী শ্রেণি সর্বহারা শ্রেণির উপর শোষণ করে। ফলে সমাজে ভারসাম্য দেখা দেয়। কিন্তু Marx বলেছিলেন, এই সর্বহারা শ্রেণি একদিন সচেতন হবে এবং পুঁজিবাদী শ্রেণির বিপক্ষে প্রতিবাদ করে।
আর এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে। এখানে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। অবশেষে আধুনিক যুগের স্বৈরাচার পতন করে, যা Karl Marx এর ভাষায় ছিল বুর্জোয়া শ্রেণি। কিন্তু এখানে আবার Georg Lukacs এর সমালোচনা বিরাজমান। তিনি মূলত মার্ক্সিস্ট ছিলেন এবং Karl Marx কে অনুসরণ করতেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘সর্বহারা শ্রেণি সচেতন নিজে হবে না। কাউকে সচেতনতা বয়ে নিয়ে আসতে হবে। ‘আর জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের প্রতিনিধি হয়ে কিছু সমন্বয়ক বিপ্লব নিয়ে আসে।
পুঁজিবাদী সমাজের কারণে সমাজে বৈষম্য, অসমতা দেখা দেয়। এতে এক শ্রেণির মানুষ সর্বহারা শ্রেণির শোষণ করতে থাকে এবং অন্য শ্রেণি শোষিত হতে থাকে। এতে সমাজে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। সমাজের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সামাজিক পরিবর্তন দরকার হয়। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পরে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আর কারণ মূলত রাষ্ট্র বা সমাজ সংস্কারের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র কতগুলো বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কার করতে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। কারণ রাষ্ট্র কখনো একা পরিচালনা করতে পারে না। সরকার, জনগণ, ভূখণ্ড এবং সার্বভৌমত্ব নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। সুতরাং সমাজের প্রতি স্তরে সংস্কার প্রয়োজন। উল্লেখ্য ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য জুলাই বিপ্লব হয়েছিল। আর সরকারের প্রশাসনিক কাজে সহযোগিতা করে আমলা। আর আমলা হয়ে থাকে অরাজনৈতিক।
ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্রের জনক। আধুনিক রাষ্ট্র ও সুশাসনের জন্য এটি অপরিহার্য। আর জনগণের মধ্য থেকে মেধার ভিত্তিতে সরকারের আমলা নিয়োগ হয়ে থাকে। সুতরাং সরকারের পাশাপাশি জনগণকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কারণ ব্যক্তির সমষ্টি ছাড়া রাষ্ট্র হতে পারে না। তাছাড়া ভাল মন্দ উপাদান নিয়ে সমাজ গঠিত। সুতরাং সমাজে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু অপরাধ দমনের জন্য আইন আছে। আর মানুষ সমাজে অপরাধী হয়ে জন্মলাভ করে না। সমাজ থেকে শিখে অনেক সময়। আবার বেকারত্বের কারণ অপরাধপ্রবণ হয়। সুতরাং বেকারত্ব নিরসনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে। আইন ও বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু আইন করলে হবে না, এর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ দুর্নীতি উন্নয়নের অন্তরায়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা আনতে হবে যেন সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটদান করতে পারে। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং রাজস্ব আদায়ে নিরপেক্ষ হতে হবে। উল্লেখ্য অনেক মানুষ স্বজন প্রীতি, ঘুষ দিয়ে রাজস্ব দেয় না।
সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এতে গবেষণার মাধ্যমে দেশের কল্যাণ হবে। দুর্নীতি মুক্ত স্বাস্থ্যখাত গড়ে তুলতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেন মানুষের জুলাই বিপ্লবের মত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।
সর্বোপরি, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ ভাল মন্দ বুদ্ধি বিবেচনা আছে। সুতরাং মূল্যবোধ ও নৈতিকতা প্রবণ হতে হবে। তাহলে সংস্কার ব্যক্তি পর্যায়ে নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে সংস্কার হবে ব্যক্তি, সংস্কার হবে রাষ্ট্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এএসজি