তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে ডাটা সেন্টারের গুরুত্ব
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪২
ইন্টারনেট হলো একটি বিশাল বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক বেবস্তা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে একসাথে বিভিন্ন কম্পিউটার, সার্ভার, এবং নেটওয়ার্ক ডিভাইস সমূহ সংযুক্ত থাকে। ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তথ্য আদান-প্রদান করে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ স্থাপনের আশেপাশে পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সেবা গ্রহণ করতে পারে। আমরা এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও স্ট্রিমিং, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও মেইল আদান প্রদান যাই করি না কেন তার মূল শক্তি হলো ডাটা সেন্টার।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে ডাটা সেন্টার হলো তথ্য কেন্দ্র। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো ডাটা জমা হওয়ার যে প্রক্রিয়া তাকে সাধারণ অর্থে ডাটা সেন্টার বলে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনায় ডাটা সেন্টার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ডাটা সেন্টার হলো একটি নির্দিষ্ট স্থান (বিল্ডিং অথবা জায়গা) যেখানে সার্ভার ও ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে ডাটা সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা হয়। একটি ডাটা সেন্টারে অনেক গুলো সার্ভার থাকে যারা নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত থাকে। আমরা যখন ব্রাউজারে কোন URL ((Uniform Resource Locator) এ প্রবেশ করি তখন তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাটা সেন্টারে প্রবেশ করে এবং সেখানে প্রসেস হয়ে আবার আমাদের কাছে চলে আসে। মূলত একের অধিক সার্ভার নিয়ে ডাটা সেন্টার গঠিত হয়। এই বিশাল পরিমাণ সার্ভার দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা (২৪/৭) নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সচল রাখার জন্য অনেকগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
তাদের মধ্যে স্থান বিবেচনা করা এবং অবকাঠামোর বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সার্ভার স্থাপনের জন্য সাধারণত এমন স্থান অথবা অবকাঠাম নির্বাচিত করা হয় যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা প্রায় ০% থেকে ৫%। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডাটা সেন্টারের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এছাড়া অনেক বড় জায়গা নিয়ে এর ভিত্তি থাকতে হবে যাতে পরবর্তী সময়ে চাহিদা মত ডাটা সেন্টারের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর যায়। ক্লাউড কম্পিউটিং আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষের সমস্ত কাজকর্ম আজ ইন্টারনেট ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার থেকে শুরু করে পড়াশোনা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি সবকিছুতেই ইন্টারনেটের আশ্চর্যজনক ছোঁয়া রয়েছে।
আমাদের দৈনন্দিন এসব কাজের পেছনে রয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রতিদিন শুধু ইউটিউবেই প্রায় চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ঘণ্টার ভিডিও আপলোড করা হয়। বিশ্বের প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (চারশ’ কোটি) মানুষ প্রতিদিন কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। এর ফলে আড়াই মিলিয়ন টেরাবাইট নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। পুরনো তথ্যের সঙ্গে এই নতুন তথ্য রাখার জন্য প্রয়োজন বিশাল তথ্য ভাণ্ডার বা ডেটা সেন্টার। বিশালাকার জায়গাজুড়ে শত শত সার্ভার নিয়ে তৈরি করা হয় একটি ডেটা সেন্টার। এদিকে ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি লোকের ডাটা সংরক্ষণ করে রাখে ফেসবুক। এছাড়াও প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিদিন এসব ফেসবুক ব্যবহারকারীরা টাইমলাইনে লেখা, ছবি, ভিডিও পোস্ট করেন যা ডাটা হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যও সংরক্ষণে রাখে ফেসবুক। ব্যবহারকারীদের ডাটা সংরক্ষণ করতে অন্যান্য টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন দেশে অনেকগুলো ডাটা সেন্টার তৈরি করেছে ফেসবুক।
ডাটা সেন্টার অনেক বড় একটি প্রোজেক্ট। ডাটা সেন্টারে সাধারণ থেকে অনেক হাই প্রোফাইল ডাটা স্টোর থাকে। যে ডাটা গুলো ডিলিট বা নষ্ট হয়ে গেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এই ডাটা গুলো নিরাপদ রাখার জন্য অনলাইন এবং অফলাইন দুই ধরনের সিকিউরিটির ব্যবস্থা রাখা হয়ে থাকে। প্রতিটি ডাটা সেন্টারের প্রাণ হলো ডাটা। বর্তমান সময়ে সব থেকে রিলায়েবল ব্যাকআপ সিস্টেম হচ্ছে ক্লাউড। ডাটা সেন্টার ডাটা সংরক্ষণ ও বিপণন করার জন্য পরিচালনা ব্যয় হিসেবে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। ইন্টারনেটকে পরিচালনা করতে গেলে এ সকল ডাটা সেন্টারের কোন বিকল্প নেই। কারণ ডাটা সেন্টার ছাড়া আমাদের ডাটা রাখা ও অ্যাক্সেস করার মত সিকিউর পদ্ধতি নেই। অন্যদিকে ডাটা সেন্টার গুলোয় ডাটা অনেক নিরাপদ ও ত্রুটি মুক্ত থাকে। শুধু তাই নয় সেখানে ডাটার পর্যাপ্ত ব্যাকআপ থাকায় কোন দুর্ঘটনায় ডাটা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। একটি ডাটা সেন্টারের কাজ হলো সার্ভার গুলোকে ৩৬৫ দিন নিরবিচ্ছিন্নভাবে সচল থাকার জন্য পাওয়ার, নেটওয়ার্ক, সিকিউরিটি, কুলিং সিস্টেম এবং অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা। ডাটা সেন্টারের প্রধান কাজ হলো ডাটা স্টোর করা এবং ইন্টারনেট সচল রাখা।
ডাটা সেন্টার মূলত একটি শীতল স্থান যেখানে সার্ভার গুলোকে র্যাকের মধ্যে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়। যাতে সার্ভারগুলো তাদের কার্য প্রক্রিয়া একটি স্বাভাবিক তাপমাত্রার মধ্যে পরিচালনা করতে পারে। যেখানে সকল ধরনের ডাটা স্টোরেজ থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট, ব্যাকআপ সহ যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা হয়। ডাটা সেন্টারে সাধারণত স্টোরেজ ডিভাইস, নেটওয়ার্কিং ডিভাইস সহ অন্যান্য অনেক হার্ডওয়্যার ডিভাইস থাকে। প্রথমত সার্ভার গুলো রেডি করার জন্য মাদারবোর্ড, প্রসেসর, র্যাম, স্টোরেজ ইত্যাদি সেটআপ করে নেওয়া হয়। পরে সেগুলো পর্যায়ক্রমে স্টোরেজ র্যাক গুলোয় সাজানো হয়। তারপর রাউটার, সুইচ, ফায়ারওয়াল সহ অন্যান্য নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ দিয়ে সার্ভার গুলোকে ইন্টারলিঙ্কিং করে তা ইন্টারনেটের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। তখন গ্রাহকেরা উক্ত সার্ভার স্পেস ব্যবহার করে সার্ভিস নিতে পারবেন। প্রতিটি সার্ভারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ভিত্তিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কোনো ধরনের ঝামেলা বাদে সব সময় ইন্টারনেটের সাথে কানেক্টেড রাখা হয়। প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা (টেম্পারেচার) মেইন্টেইন করা হয়। এই সকল কিছু সঠিকভাবে পরিচালনা করার পর তা প্রান্তিক পর্যায়ে কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এদিকে ইন্টারনেট হলো ডাটা সেন্টারের হার্ট। ডাটা সেন্টারগুলোতে যে সার্ভার বসানো থাকে সেগুলো থেকে ডাটা আদান-প্রদান সহ যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজন হলো ইন্টারনেট। আর এই ইন্টারনেট কানেক্ট করার জন্য ঝামেলাহীন একটি নেটওয়ার্কিং অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত সার্ভার গুলো তাদের নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন করার জন্য একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।
এই নেটওয়ার্ক এর সাথে ইন্টারনেট জুড়ে দেয়া হয়। এর ফলে উক্ত ডাটা সেন্টারের ডাটা গুলো ইন্টারনেটে অবস্থিত ইউজারেরা ব্যবহার (অ্যাক্সেস) করতে পারেন। এ কারণে সেন্টারগুলোতে উন্নত মানের রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ ও ফায়ারওয়াল সহ নেটওয়ার্ক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এদিকে সঠিক ভাবে নেটওয়ার্ক সেটআপ করতে না পারলে সার্ভার ইরর বা ডাউন হয়ে থাকবে। অপরদিকে নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারলে সার্ভার হ্যাক হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। একটি ডাটা সেন্টারে একই সাথে অনেকগুলো সার্ভার দিনরাত চব্বিশ (২৪/৭) ঘণ্টা সচল থাকে। এই অনবরত চলার কারণে প্রতিটি সার্ভারে তাপ উৎপন্ন হয়। এখন কোন পদ্ধতি ইউজ না করে যদি তাপ নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে হার্ডওয়্যার নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে ডাটা সেন্টারের সার্ভার নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বহুগুণ। এ কারনে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কুলিং সিস্টেমের ব্যবস্থা রাখা হয়। এদিকে একটি তথ্য কেন্দ্র পরিচালনার প্রধান শক্তি হলো পাওয়ার।
ডাটা সেন্টারে যে সকল যন্ত্রাংশ থাকে তার প্রায় সবগুলো বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু পাওয়ার ছাড়া সার্ভার, কুলিং সিস্টেম, নেটওয়ার্ক কোন কিছুই কাজ করবে না সেহেতু এর কোন বিকল্প নেই। তাই প্রতিটি ডাটা সেন্টারে প্রাইমারি পাওয়ার সাপ্লাই সুবিধা সহ সেকেন্ডারি এবং ব্যাকআপ পাওয়ার ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরী। এ কারণে প্রতিটি সেন্টার পাওয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য UPS, জেনারেটর ও পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন ইউনিট (PDUs) সিস্টেম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে নেটওয়ার্ক ডিভাইস, সার্ভার, কুলিং সিস্টেম সহ সকল ইলেকট্রিক পণ্য পর্যাপ্ত পাওয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। নেটওয়ার্কিং ডাটা সেন্টার যা ইন্টারনেটের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডাটা সেন্টারকে তার প্রধান উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে।
প্রোপার নেটওয়ার্কিং না থাকলে সার্ভারগুলো যেমন নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করতে পারবে না তেমনি ইন্টারনেটের সাথেও সংযুক্ত হতে পারবে না। এই কারণে ত্রুটি মুক্ত নেটওয়ার্কিং অবকাঠামো তৈরি করে তা সঠিক ভাবে ইমপ্লিমেন্ট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এএসজি
ডাটা সেন্টার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মুক্তমত মো. জাহিদুল ইসলাম