ফিরে দেখা ২০২৪: নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা
২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৫০ | আপডেট: ২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৯
শেষ হয়েছে ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল। অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে দেড় দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশ শাসন করা সরকারের। এ ঘটনায় দেশে আর্থসামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাগুলো আরো তীব্র হয়ে ওঠে। যদিও দেশের অর্থনীতিতে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। গত হতে চলা ২০২৪ সালে দেশের অগ্রযাত্রার চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয় আয়োজন চলছে বিভিন্ন মহলে। অনেকেই বলছেন ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল বছর। বছরের শুরুটা হয়েছিল একটি বির্তকিত সংসদ নির্বাচন দিয়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসন সাজানো, সরকারপন্থি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়নের পাশাপাশি ভিন্ন মতাদর্শের কর্মকর্তাদের ওএসডি, বদলি, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা বছরের শুরুতেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এরইমধ্যে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূখে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং নতুন অন্তর্বতী সরকার গঠনের পর প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল শুরু হয়। সেই রদবদলে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা গত প্রায় পাঁচ মাসেও সমাধান হয়নি। এই বিশৃংখলা মাথায় নিয়েই বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল।
রাজনৈতিক সহিসংতা ছিল বছর জুড়ে
নির্বাচনকে ঘিরে বছরের শুরু থেকেই দেখা যায় রাজনৈতিক কোন্দল। এরপর ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, ঘিরে তোলপাড় ছিল সারা দেশ। একপর্যায়ে নজিরবিহীনভাবে ভেঙে পড়ে পুলিশি ব্যবস্থা। এই বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল কলকাতায় বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য (ঝিনাইদহ-৪) আনোয়ারুল আজীমকে নৃশংসভাবে হত্যা। ১২ মে ভারতে গিয়ে পরদিন রাতে কলকাতার একটি বহুতল আবাসিক ভবনে তাঁকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। পরে কলকাতার দুটি স্থান থেকে কিছু হাড় ও মাংস উদ্ধার করা হয়। ২০২৪ সালে বড় ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে (সাততলা) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড অন্যতম। এতে নারী, শিশুসহ ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ বছরের ৫ জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন কারও ধারণাই ছিল না যে পরের দুই মাসের মধ্যে সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এটি শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের টানা শাসন অবসানের দিকে নিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় দেশজুড়ে বেশ কিছু হতাহত ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার শক্ত অবস্থান না নিতে পারায় এসব ঘটনা বাড়তে থাকে
প্রশাসনে অস্থিরতা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগষ্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার গঠনের পর পরই সরকারের উপর প্রথম ধাক্কাটি আসে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া ১১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল নিয়ে । এরপর থেকে শুরু হয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল। সেই রদবদলে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক অবসরে, আবার কিছু কর্মকর্তাকে করা হয় ওএসডি। অনেককে বদলি করে অন্যত্র পাঠানো হয়। আবার সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা হয় হত্যা মামলা।সেই মামলায় গ্রেফতার হোন ১২ জন সাবেক আমলা। যা প্রশাসনে ছিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। প্রশাসন সংস্কারের এ উদ্যোগে পরিবর্তন আনা হয় মাঠ প্রশাসনেও। দুই দিনে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৫১ জেলায় নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর নিয়ে বিক্ষুদ্ধ হন নিয়োগ বঞ্চিত কিছু কর্মকর্তা। উপসচিব পর্যায়ের ওই সকল কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে তাৎক্ষনিকভাবে আট জেলার ডিসি নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। ওই ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। যা অন্তর্বতী সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশাসনের রদবদলে ওএসডি, বদলি, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ছিল কর্মর্কতাদের মধ্যে উদ্বেগ। ছিল মামলা আতঙ্ক। ৫ আগস্টের পর প্রতিদিন পুলিশের বিভিন্ন পদে আসছে নতুন মুখ। গত কয়েক মাসে বদলি ও পদায়ন পেয়েছে ঝড়ের গতি। এ সময়ে সারা দেশে পোশাকধারী দুই লাখ দুই হাজার পুলিশের বিপরীতে রদবদল করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য। সে হিসাবে প্রায় ৩০ শতাংশ পুলিশের চেয়ার বদলে গেছে। অল্প সময়ে এত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের কর্মস্থল বদলের ঘটনা নজিরবিহীন। ৬৪ জেলার পুলিশ, সব রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর কমিশনার এবং সব থানার ওসি পদে আসে নতুন মুখ। পুলিশে এককভাবে সবচেয়ে বড় ইউনিট হলো ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অন্তত ৩২ হাজার সদস্য এখানে কাজ করেন। এ পর্যন্ত এখানকার ১৮ হাজার সদস্যকে বদলি করা হয়েছে।
শিক্ষায় নতুন কৃষ্ঠি
সম্প্রতি আন্দোলনের পর প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছিল। উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ— কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না। এর কারন আন্দোলন কারী ছাত্ররা মনে করছে বিগক সরকারের আমলের কোন সংন্থা প্রধানকে তারা রাখবে না ফরে উপাচায্য,প্রধান শিক্ষক কিংবা কলেজ অধ্যক্ষ কেহই এ থেকে বাদ যায়নি যা বছরের একটি সছেয়ে আলোচিত ঘটনা যাতে দেখা যায় কিভাবে ছাত্র কতৃক শিক্ষক লান্ছিতত হয় । যার ফলে বিশেষত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে এখনও পরিস্তিতি সাভাবিক হয়নি এবং শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের যে শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা ফেরানো এত সহজ হবে বলে মনে হয় না । ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় দেশজুড়ে বেশ কিছু হতাহত ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার শক্ত অবস্থান না নিতে পারায় এসব ঘটনা বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গণপিটুনিতে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় যা উদ্বেগ ও নিন্দার ঝড় উঠে।
পোশাক শিল্প
বিদায়ী বছরে দেশের পোশাক খাত অস্থির সময় অতিক্রম করেছে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শ্রমিক বিক্ষোভে প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে পোশাক খাতের উৎপাদন কার্যক্রম। একাধিক কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকে বিভিন্ন পোশাক কারখানা। দেখা দেয় পণ্য পরিবহন সংকট, শিপমন্টে করতেও বেগ পেতে হয়ে উদ্যোক্তাদের। আবার বহির্বিশ্বেও দেশের পোশাক রফতানি কমেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানির ধরা ছিল একেবারেই নেতিবাচক। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের দামও কমেছেএদিকে দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকরা পেয়েছেন সুখবর। দীর্ঘ আন্দোলনের পর নতুন বছর থেকে ৯ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি) আদায় করে নিয়েছেন তারা। আর বিদায়ী বছরে প্রায় ২৬টি পোশাক কারখানা সবুজ কারখানার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে পোশাক খাতে শ্রমিক অস্থিরতা ও রফতানি ধরে রাখাই ছিল বিদায়ী বছরের সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ।
মুল্যস্ফীতির অভিঘাত
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। প্রায় দেড় বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়।আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে গেলে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বাড়ে। এমনিতেই বাজারের জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, অক্টোবর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। সেটিও আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
অর্থনীতিতে আইএমএফের প্রভাব
বিগত সরকারের শেষ বছরগুলো যেকোনো সময় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধসের আশঙ্কার মধ্য দিয়ে ছিল । বিপর্যয় ঠেকাতে সরকার দ্বারস্থ হয় আইএমএফ এর কাছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বেশকিছু শর্ত বেঁধে দেয়া হয় যেমন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোসহ বেশকিছু খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়া হয় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে দেয়া, নিট রিজার্ভ বাড়ানো, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত সংস্কার এবং ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ হ্রাসেও জোরারোপ ইত্যাদি। এসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টো আরো জোরালো হয়ে জেঁকে বসে মূল্যস্ফীতি। প্রসঙ্গত ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদহার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
ব্যাংক খাত ও খেলাপি ঋণ
বছর ব্যাপি ছিল গ্রাহকের অনাস্তা,তারল্য ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ প্রাধান্নতা । দশটি দবল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা সত্বেও দাড়াতে পাড়তে সক্ষম হচ্ছে না । এর মূল কারন হিসাবে দেখা হয় খেলাপি ঋনকে । বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সংখ্যার সঙ্গে কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নেয়া ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করা হলে পরিমাণটা আরো অনেক বেশি। অনেকের মতে, এর পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত আগস্টে সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের তৃতীয় কোয়ার্টারে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
বাজেট বাস্তবায়ন মন্থর
বিগত সরকার গত জুন,২০২৪ এ একটি বাজেট (২০২৪-২৫)মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন যেখানে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বছরের শুরুতে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে কোটা আন্দোলনের ফলে সরকার ৫ই আগষ্ঠ পদত্যাগ করে এবং এ পরিস্থিতিতে (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি মন্থর হয়ে পরে যা উন্নয়নের জন্য একটি বড় বিপর্যয় বলে প্রতিয়মান হয় ।তথ্য বলছে অর্থবছরের শুরুর দিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি এমনিতেই ধীর থাকে।আর চলতি পরিস্থিতিতে এটা হবে তা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে মোট ব্যয় হয়েছে ৯৬ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়েছে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। এর পরেই রয়েছে প্রশাসনিক (২৩ দশমিক ৭ শতাংশ) ও সামাজিক খাতে (২০ দশমিক ১ শতাংশ) ব্যয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, আলোচ্য সময়ে ঋণের সুদ পরিশোধে ৪২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি তিন মাসের পরিচালন ব্যয়ের ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বাজেটে এ খাতে মোট বরাদ্দের ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধস নেমেছে। বাজেটে মূল এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ছয় মাস কেটে গেলেও অনেক মন্ত্রণালয় এখনো কাজই শুরু করতে পারেনি। বাকিগুলো এডিপির কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থছাড়ে ধীরগতি এবং প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের প্রভাব পড়েছে এডিপি বাস্তবায়নে। অর্থ বিভাগের হিসাব মতে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এটি এডিপি বরাদ্দের মাত্র ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ে অপারগতা
চলতি অর্থবছরের এনবিআর আওতাধীন মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। । অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৩২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭৬ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা (বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা (বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৫২ দশমিক ১ শতাংশ)। এনবিআর আওতাধীন রাজস্বের মধ্যে আয়কর খাতে ২৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে ৩০ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ও সম্পূরক শুল্ক খাতে ৯ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। অর্থ বিভাগ জানায়, রাজস্ব আদায়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তবে বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
ঋণ নেয়ার প্রবনতা লক্ষনীয়
রাজনৈতিক পালাবদলের ধাক্কা লেগেছে উন্নয়ন কর্মকান্ডে। অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি নেই। এর ফলে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।গত অর্থবছর ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ। তবে এবার বেশি টাকার বরাদ্দই বাদ দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাওয়া হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান আছে এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়িয়ে ডলার সংগ্রহ বৃদ্ধি করা। এদিকে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক-বহির্ভূত সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা নিট ঋণ নেয়া হয়েছে এবং ব্যাংক-বহির্ভূত অন্যান্য খাতে ৯ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক-বহির্ভূত খাতে তিন মাসে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ২৫ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ নিয়েছে এবং এ খাতে ২৬ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা স্বল্প মেয়াদি ঋণ পরিশোধ করেছে। অর্থ বিভাগ জানায়, অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক উৎস থেকে ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে এবং ৭ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। বিদেশি ঋণের পরেও আর্থিক চাপ কমবে না ।ঋণদাতাদের কাছ থেকে আরো বেশি বিদেশি ঋণ সংগ্রহ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে দেশের প্রত্যাশিত রাজস্ব আয়ে ঘাটতির কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চাপ কমবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ মুহূর্তে এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসেছে, সবাই মনে করছেন যে ব্যাপক সংস্কার সাধনের এটাই উপযুক্ত সময় এবং এই দুর্লভ সুযোগটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে এমন কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, যেগুলো কিনা ইএসজি বাস্তবায়ন, ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, জনগণের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে একটি স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং সব ধরনের দুর্নীতি দমন করবে। এ কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হবে এবং কোনোভাবেই বিশেষ করে আর্থিক খাতের দুর্বলতাগুলো উপেক্ষা করা যাবে না। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে পুঞ্জীভূত বিপুল খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং অপর্যাপ্ত জবাবদিহিতার নজির তৈরি হয়েছে। এই ত্রুটিগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে এর মাশুল দিয়ে চলেছে জাতি। তাই জাতী আশা করছে সবাই মিলে বর্তমান সরকারকে সহযোগীতা করা এবং সন্কার কর্মসূচী যাতে অব্যাহত থাকে সে জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি