পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে আর কত তামাশা?
২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫২
গত ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ তম বিসিএসের চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। দীর্ঘসূত্রিতার পরে প্রজ্ঞাপন জারি অব্যশই চাকুরীপ্রার্থীদের নিকট অতি আনন্দের সংবাদ। ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বরে, যাতে অংশ নিতে বিসিএসের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আবেদন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জনের জমা পড়েছিল। সকল প্রক্রিয়া শেষ করে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২,১৬৩ জনকে পিএসসি বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ১৫ অক্টোবর ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে পরে স্থগিত করে। দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে নতুন করে ১৬৮ জনসহ মোট ২৬৭ জনকে বাদ দিয়ে নতুন করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগযোগ মাধ্যামে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। নতুন বাদ পড়া ১৬৮ জনকে কি জন্য বাদ দেয়া হলো তা অনেকেই জানেন না। সাধারনত আমরা গত কয়েক বছরে দেখে এসেছি, এসকল ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই বাদ দেয়া হয়ে থাকে । তবে গতকাল বেশ কয়েকজন বাদ পড়া চাকুরী প্রার্থী দাবি করেছেন তারা কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত না এমনকি অনেকেই বৈষম্যবিরোধী ও কোটা বাতিলের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন কয়েকজন। এমনটা নয় যে তারা মিথ্যা দাবি করছে কারণ তাদের পক্ষেও তাদের ছোট ভাই, বড় ভাই এবং বন্ধুরাও স্ট্যাটাস দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মধ্য বিত্ত ও নিম্নবিত্তরাই সাধারনত সরকারি চাকুরির প্রতি বেশি ঝুকে আর গত এক দশকে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক আশা আকাঙ্খা থাকে সরকারি চাকুরি এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন থাকে একটি চাকুরি। তবে মেধা এবং যোগ্যতা থাকার পর ও যদি কেউ রাজনীতির কারণে বাদ পড়ে তা হলে তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর যে কাজটায় সবচেয়ে বেশি বাহ্বা পেয়েছে তা হলো বিসিএস-এ গত ১৫ বছরে যাদের গেজেট রাজনৈতিক কারণে আটকে ছিলো এমন ২৫৯ জনের গেজেট প্রকাশ করা। যাদের সাথে শুধু রাজনৈতিক কারণে বৈষম্য করা হয়েছে তাদের চাকুরি ফিরিয়ে দিয়ে তরুণদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু এরপরই প্রায় ৩০০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষনরত এসআই এবং ৬৬ জন প্রশিক্ষনরত এএসপি’র প্যারেড স্থগিত আর সর্বশেষ ২৬৭ জনের গেজেট আটকে দেয়াতে ছাত্র সমাজের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন গত ১৫ বছরে ২৫৯ জনের গেজেট আটকানো হয়েছিল আর এ সরকার গত ৪ মাসেই প্রায় ৮০০ জনের চাকুরি কেড়ে নিলো। যে বৈষম্য নিরোসনে আন্দোলন করা হলো সে বৈষম্যই যেন নতুন করে শুরু হলো।
এর আগে ও পুলিশের চাকুরি থেকে বাদ পড়াদের নিয়ে ‘লঘু পাপে গুরু দন্ড’ নিয়ে লেখায় দেখিয়েছিলাম কিভাবে পরবর্তীতে চাকুরি ফিরে পেলে তারা হয়ে উঠবে এক একজন হারুন কিন্তু হতে পারতো তারা এক এক জন দেশপ্রেমিক, তা না হয়ে তারা হয়ে উঠবে কোন দল প্রেমিক। কারন যেই দল তাদের চাকুরি ফিরিয়ে দিবে তারা সেই দলেরই আনুগত্য করবে এটা স্বাভাবিক। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, দুটি কারণে এদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে, একটি রাজনৈতিক এবং অন্যটি ফৌজদারি মামলা। তবে মজার বিষয় হলো পুলিশে ভেরিফিকেশন ফরমে চাকুরি প্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শের কোন কলাম নেই। তার ব্যাক্তিগত ও মামলা থাকলে এবং পরিচয় নিশ্চিত করাই পুলিশ রিপোর্টে থাকার কথা কিন্তু আমরা বিগত আমলে দেখেছি পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে মূলত যাচাই করা হয় রাজনৈতিক মতবাদ, যা সুস্থ রাজনীতির অন্তরায়। তবে বাদ পড়া বেশ কয়েকজন এর কোনটার সাথেই সম্পর্কিত নন, তারপরও তারা কোন অজানা কারণে বাদ পড়েছে সে কারণ কারো জানা নাই। দুটি কারণের মধ্যে একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণ র্অথাৎ বিগত সময় যারা ছাত্রলীগের রাজধানীর সাথে যুক্ত ছিলো, আমরা দেখেছি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন গুরুত্বর্পূণ নেতা ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪-এর গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা, অনেকেই সে সময় পদত্যাগ করেছেন। বিগত পনের বছরে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছিল যে একটি সরকারি চাকরির জন্য অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নিজের নাম লিখিয়েছেন, বর্তমান প্রেস সচিবও একই কথা বলেছেন ‘অনেকে ছাত্রলীগ করত একটি চাকরির আশায়’- এটাই বাস্তব। আবার কোটা বাতিল আন্দোলনের সময় মাঠের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অনেক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তাহলে ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির সময় এ সকল শিক্ষার্থীরা কি রাজনৈতিক কারণেই বাদ পড়বেন? পরিস্থিতি কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে না? তাহলে এ আন্দোলন তাদের কাছে অনেকটাই শাখের করাত হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে তারা ছাত্রলীগের কর্মী, অন্যদিকে আওয়ামীলীগ বলছে তারা বিশ্বাসঘাতক।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার কারিগররা যদি নতুন বৈষম্যের শিকার হন তাহলে সাধারণ ছাত্ররা কোথায় গিয়ে দাঁড়বে? আর এখনো যদি সেই পূর্বের মতো রাজনৈতিক পরিচয় প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে যে দল সরকার গঠন করবে, চাকরি পাওয়ার আশায় শিক্ষার্থীরা সেই দলের ছায়াতলে গিয়ে আশ্রয় নিবে। আর ক্ষমতা বদলালে সেই সকল নেতারা পূর্বের ন্যায় বৈষম্যের শিকার হবে। এমন বাংলাদেশ তো আসলে শিক্ষার্থীরা চায়নি। সবার মধ্যেই রাজনৈতিক একটি সত্তা থাকে। তাইতো এরিস্টটল বলে গেছেন মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি থেকে কেউ বাইরে নয়। বিগত শাসনামলে যেমনি বিরোধী রাজনীতির কারণে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাদ দেয়া হয়েছে ঠিক একই কারণে এখনো চাকুরি থেকে বাদ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। এরমধ্যে যদি কেউ অপরাজনীতি অথবা কোন ফৌজদারি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে কেবল রাজনীতির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। যদি এইরকম প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে নতুন কোন সরকার এসে তার নিজস্ব দলীয় লোক নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী, না জেনে বুঝে অথবা সামান্য সুযোগ সুবিধার লোভে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে থাকে। তবে এদের মধ্যে গুটি কয়েক দলীয় ক্যাডার হিসেবে কাজ করে থাকে।
লেখক: প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
সারাবাংলা/এএসজি