জনকল্যানমুখী প্রশাসনের জন্য প্রয়োজন সংস্কার
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:১৩
বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস নিয়ে বিতর্ক চলছেই। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় গুলোতে প্রশাসন ক্যাডারে আধিপত্য, সেবায় দীর্ঘসূত্রিতা, জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতিসহ নানান রোগে আক্রান্ত। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হল সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। যা নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এবং তারা সংস্কার কমিশনের প্রধানের পদত্যাগও দাবি করেছেন। বিভিন্ন উচ্চপদস্থ প্রশাসন ক্যাডারের বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর বেশিরভাগ পাঠকই তা নেতিবাচকভাবে নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা ও বৈষম্যদূর করার দাবিতে আন্দোলনের নামার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রশাসনে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে।
ব্রিটিশরা ২০০ বছর এ অঞ্চল শাসন করে যাওয়ার সময় এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা রেখে গিয়েছে। যা তারা ব্যবহার করেছিল তৎকালীন মানুষকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। পাকিস্তান আমলেরও অবসান হয়েছে কিন্তু ব্রিটিশদের সেই রেখে যাওয়া সিভিল সার্ভিস এখনো চলমান। ২৫০ বছরের পুরনো সিস্টেম দিয়ে বর্তমান যুগে ভালো সিভিল সার্ভিস আশা করাটাও বোকামি। যেখানে ব্রিটিশরাই তাদের অনেক সিস্টেম নতুন করে চালু করেছে। আমলাতন্ত্র একটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দেশে পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক আমলাতন্ত্রের জনক ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন আমলাতন্ত্র হতে হবে মেধা ভিত্তিক, সব কিছুর থাকবে লিখিত দলিল, থাকবে প্রফেশনালিজম। তবে ম্যাক্স ওয়েবারের আমলাতন্ত্রের একটি বড় সমস্যা হলো এটি সময় সাপেক্ষ এবং লাল ফিতার দৌরত্য বৃদ্ধি করে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রশাসনের দিকে তাকালে আমরা তাই দেখতে পাই, যেকোন ছোট একটি কাজও যেতে হয় মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। আর মন্ত্রণালয়ের ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। আমরা যাকে নাম দিয়েছি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া না হলে ফাইল যেন নড়েইনা। আর এ সকল মন্ত্রণালয়ের প্রধানরা থাকেন মূলত প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনই। বাকি ক্যাডারের লোকজনদের প্রমোশন, বদলিসহ বিভিন্ন রকমের ফাইল নিয়ে ধরনা দিতে হয় প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনের কাছে। এজন্যই হয়তো প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বাকি সকল ক্যাডাররা দাবি করছেন ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার। তাদের দাবিতেও কিছুটাও অসংগতি রয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনও তাদের মন্ত্রণালয় ছাড়তে নারাজ। সবকিছু মিলিয়ে ক্যাডারদের মধ্যে অনেক বড় একটি দ্বন্ধ বিদ্যমান। এ অবস্থা চলতে থাকলে এর পরিনাম ভোগ করতে হবে জনসাধারণকেই।
প্রশাসন ছাড়া যেহেতু কোন রাষ্ট্রই চলা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে কি সব রাষ্ট্রেই এমন দ্বন্দ্ব চলমান? উত্তর নিশ্চয়ই না। তাহলে তারা তাদের মন্ত্রনালয়গুলো কিভাবে পরিচালনা করে, তা জানা যাক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রের প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষে সিনিয়র ম্যানেজার (সিভিল সার্ভেন্ট) রয়েছেন, যাদের বিভিন্ন নাম বা উপাধি রয়েছে এবং বিশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়া রয়েছে। ফ্রান্স তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগপ্রাপ্তদের আগে নির্বাচন করা হতো ENA (École Nationale d’Administration) থেকে। এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক সার্ভিস (INSP), যা ১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রতিষ্ঠিত, আই এন এস পি ধারা এখন সিনিয়র ম্যানেজার নির্বাচন করা হয়। এছাড়াও আই এন এস পি কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট এবং ম্যানেজারদের, শিক্ষা এবং পেশাদারী উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সিভিল সার্ভিস সংস্কারের চিন্তা ফসল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আই এন এস পি- যার লক্ষ্য হলো সরকারি সেবার উন্মুক্ততা, বৈচিত্র্য এবং সেবার মান বৃদ্ধি করা।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্য একটি দেশ নেদারল্যান্ডস, যা কয়েক বছর আগে একটি সিনিয়র সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করেছে, সেখানে শীর্ষ পর্যায়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রাইভেট সেক্টরের মতো করা হয় (যেমন: পত্রিকায় শূন্যপদ প্রকাশ, প্রার্থীদের সিভি বিবেচনা, নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে সাক্ষাৎকার ইত্যাদি)। যেকোনো ব্যক্তি (প্রশাসনের ভেতর থেকে বা বাইরের) যোগ্যতা পূরণ করলে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
এছাড়া, যুক্তরাজ্যে পার্মানেন্ট সেক্রেটারি, তাদের ডেপুটি এবং আন্ডার সেক্রেটারিগণ (গ্রেড ১ থেকে ৫) সাধারণত সিভিল সার্ভিসের ভেতর থেকেই নিয়োগ পান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেড ১ থেকে ৩-এর শূন্যপদ বাইরের প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, যা প্রধানত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেইনি এবং হায়ার এক্সিকিউটিভ অফিসার স্কিম-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে আবেদনপত্র মূল্যায়ন, একটি কঠিন বাছাই পরীক্ষা, এবং নির্বাচিত প্রার্থীদের জন্য সিভিল সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের অতিরিক্ত পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত। সিলেকশন বোর্ড সুপারিশ করে এবং ফাইনাল সিলেকশন বোর্ড চূড়ান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
স্পেনে কিছু পদ- যা সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পদ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেগুলো সিভিল সার্ভেন্টদের দ্বারা পূর্ণ হয়। তবে নির্দিষ্ট যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা থাকলে সিভিল সার্ভেন্ট নন এমন ব্যক্তিরাও এই পদে আবেদন করতে পারেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া হয় শূন্যপদের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। এসব নিয়োগ সবসময় সাময়িক হয় এবং অপসারণের পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী বা অনুরূপ সিভিল সার্ভিস পদের দায়িত্বে ফিরে যান।
তুর্কি সিভিল সার্ভিস সিস্টেম সিভিল সার্ভ্যান্টস আইন (৬৫৭) দ্বারা শাসিত এবং এটি মূলত মেধা এবং প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগের নীতির উপর ভিত্তি করে। নিয়োগ মূলত সিভিল সার্ভিস সিলেকশন পরীক্ষা (KPSS)-এর মাধ্যমে করা হয়। এছাড়া, উচ্চতর পদের জন্য পদোন্নতি পেতে হলে ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করতে হয়। যদিও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাব এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য রাষ্ট্রগুলো সরকারি সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ প্রথা সমান সুযোগ এবং মেধাভিত্তিক নির্বাচনের মূলনীতি গুরুত্ব পেয়েছে। ঐসকল দেশ গুলোতে দুটি প্রধান মডেলের মাধ্যমে মূলত নিয়োগ হয়ে থাকে। একটি ক্যারিয়ারভিত্তিক সিস্টেম, যা ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো দেশগুলিতে অনুসরণ করা হয়। যেখানে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং কাঠামোবদ্ধ ক্যারিয়ার অগ্রগতি উপর নির্ভর করে, অন্যটি পজিশনভিত্তিক সিস্টেম, যা নেদারল্যান্ডস এবং নর্ডিক দেশগুলিতে দেখা যায়, যেখানে বিশেষ চাকরি প্রয়োাজনীয়তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং প্রায়শই বেসরকারি খাতের প্রথার সাথে মিলে যায়। এ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষত উচ্চ পদস্থ নিয়োগে যেখানে মন্ত্রীরা নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়োগ দিতে পারেন, যেমনটি বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং স্পেনে প্রচলিত আছে।
সুতরাং আমরা দেখলাম যে, উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো তাদের সিভিল প্রশাসনকে জনকল্যাণমুখি করতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংস্কার নিয়ে আসছেন। এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের জন্য সিনিয়র সিভিল সার্ভিস নামে একটি সিভিল সার্ভিস গঠন করেছেন। যাদের কাজ হল, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের জন্য অভিজ্ঞ এবং যোগ্য লোক খুঁজে বের করা। সেটা পরীক্ষা ভাইবা বা যে কোনভাবে হতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমূলক করে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই তার প্রশাসনকে জনকল্যাণমূলক করতে হবে। উন্নত বিশ্বে প্রশাসক ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা ম্যানেজার বা কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেন। যাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। আর আমাদের দেশে এখনও অনেক সরকারী অফিসারকে স্যার না ডাকলে সেবা পাওয়া যায় না বরং কিছু ক্ষেত্রে স্যার ডাকার জন্য বাধ্য করা হয়। এ মন মানসিকতা বদলাতে হবে। জনকল্যাণ মুখী প্রশাসন গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে। বৈষম্য দূর এবং জনকল্যাণমুখী প্রশাসন করার নিমিত্তে সরকার চারটি সিভিল সার্ভিস গঠন করতে পারে। জেনারেল ম্যানেজমেন্ট সিভিল সার্ভিস, হেলথ সিভিল সার্ভিস, এডুকেশন এন্ড টেকনিক্যাল সিভিল সার্ভিস ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট সিভিল সার্ভিস। তিনটি সিভিল সার্ভিস তাদের চাহিদা মোতাবেক পরিক্ষার মাধ্যামে লোকবল নিয়োগ দিবেন। যেখানে জেনারেল ম্যানেজমেন্ট সিভিল সার্ভিসের অধীনে সরকারের মাঠ প্রশাসন পরিচালনা করবেন আর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের সিভিল সার্ভিস থাকবে আলাদা। সরকারের মন্ত্রনালয় পরিচালনার ও উর্ধ্বতন প্রশাসন এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের জন্য লোকবল নিয়োগ দিবেন সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট সিভিল সার্ভিস। যেখানে আবেদন করতে পারবেন সবগুলো ক্যাডার থেকেই। সংশ্লিষ্ট কাজে পারদর্শি, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রার্থীকেই সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রনালয়ে সংযুক্ত করা হবে।
এখনই সময় এসেছে, বাংলাদেশের প্রসাশনকে আরো জনকল্যাণমুখী করে তোলা এবং সেই পূর্বের অচলায়তন ও লাল ফিতার দৌরত্ম থামিয়ে দিয়ে একটি জনকল্যানমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার।
লেখক: প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
সারাবাংলা/এএসজি