আমরা যদি মানুষ না হই, সোনার বাংলা হবে কীভাবে?
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩২
বিজয়ের মাস শেষের পথে। আমাদের বাঙ্গালি জাতির কাছে এই মাসটা বেশ গৌরবের এবং অহংকারের। এই মাসেই আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে বিজয়ের ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে। অর্ধশত বছরের বেশি সময় গেলেও এই স্বাধীনতা নিয়েও আমরা ছিলাম ভয়ে, শংকায়। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আমরা কখনোই স্বাভাবিক পাইনি। কোনো না কোনোভাবে আমাদের দেশে একটা অস্থিরতা লেগেই থাকে।
সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের দেশে গত ৫ আগস্ট এসেছে নতুন ভোর। আমরা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান পেয়েছি, পেয়েছি নতুন সরকার। এতেই কি দায়িত্ব কিংবা দায় শেষ? সবকিছুর সমাধান হয়ে গেল? সত্যি বলতে দেশ এভাবে পাল্টাবে না। এভাবে আগামী ১০০ বছরেও দেশের কিছুই হবে না। এই দেশকে পাল্টাতে হলে আপনাকেও এই যাত্রার সারথি হতে হবে। এই দেশকে পাল্টাতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম মানুষ হতে হবে। এই দেশকে পাল্টাতে হলে এদেশের মানুষরূপী অমানুষদের চিহ্নিত করতে হবে। তবেই দেশ পাল্টাবে।
এই কথাগুলোর কারণ আছে, সেদিকেই এগুচ্ছি। দেশের ক্ষমতা পাল্টেছে বলে অনেকেই মনে করেন দেশের মানুষের পরাধীনতা কেটেছে। সত্যি বলতে দেশের মানুষ কি চায়? এই একটা বাক্য অনেকেই বুঝতে পারেন না। অনেকেই এই বাক্যটার মর্মটাও উপলব্ধি করতে পারেন না। এদেশের মানুষ শ্বেতপত্র, সংবিধান, সংস্কার, তত্ববধায়ক এই ধরনের কঠিন বাক্য বুঝে না। এই দেশের মানুষ বুঝতে চায় ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে কি-না। এদেশের মানুষ চায় চিকিৎসার খরচ কমেছে কি-না। এদেশের মানুষ চায় জান-মালের নিরাপত্তা।
অথচ সেই লক্ষণ এখনও দেখছি না। বাজারে গেলেই সেটার প্রমাণ পেয়ে যাবেন। না আছে সবজির মূল্য কম, না আছে মাছ-মাংসের দাম কম। ছোট বেলায় মায়ের কাছে শুনতাম, মুলা নামক সবজিটা না-কি গ্রামের গরুদের খাওয়ানো হতো। এতোটাই সস্তা ছিলো এই সবজি। অথচ বাজারে এখন একটা মুলার দাম ওজন করলে ৩০-৪০ টাকা হয়। আর আলুর কথা কি বলবো! আলুর কেজি ৭০ থেকে ৯০ টাকা।
এই তো গেলো বাজারের কথা, পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় ধর্ষণ আর ধর্ষণ। গণমাধ্যমে এই লোমহর্ষক ঘটনা গুলো পড়তেও পারি না। বুক কেপে উঠে। ময়মনসিংহের নান্দাইলে প্রেমে রাজি না হওয়ায় গত ১ জুন ১৪ বছর বয়সি মাদ্রাসা ছাত্রী তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। নির্যাতনে অসুস্থ মাদ্রাসা ছাত্রীটির মৃত্যু হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে তিন যুবক। শুধু তাই নয়, গত ২১ নভেম্বর রাতে কুষ্টিয়ার এক মাদরাসায় ১২ বছরের এক ছেলে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে মাদরাসার সুপার। গত ১১ অক্টোবর নেত্রকোনায় নারী ইউপি সদস্যও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাননি। এভাবে আমি তথ্য দিতে থাকলে হয়তো শত শত তথ্য যুক্ত করতে পারবো। কিন্তু আমাদের বোধ পাল্টাবে না। কারণ আমরা নিয়মিত এসব খবরে অভ্যস্ত। আমাদের কাছে এসব খবর এখন ডালভাত। কিন্তু যে নারীর সাথে এই ঘটনা ঘটেছে সেই নারী এবং তার পরিবার এই ব্যাথা অনুভব করতে পারে। আপনার আমার কাছে এসব কিছুই না। যে শিশুর সাথে এমন অন্যায় হয়েছে সেই শিশুর পরিবার জানে তাদের বুকের ব্যাথাটা কতখানি। আমার আপনার ঘরের শিশুর সাথে না হলে আমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারবো না। পারবো না বললে ভুল হবে, আমরা আসলে উপলব্ধি করতেই চাই না।
আমাদের সমাজের এই চিত্রখানিতে ক্ষমতা, সরকার এসবের হাত কতখানি? আর কতখানি আমাদের নিজেদের দায় রয়েছে সেটাই আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। আমাদের দেশের আইন-শৃংখলা বাহীনিও তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সত্যি বলতে সমস্যাটা আমাদের ভেতর। আমরা কি আদৌ মানুষ হতে পারছি? কিংবা আমরা কি আদৌ মানুষ হতে পারবো? সেই প্রশ্ন আপনাদের কাছেই রেখে গেলাম।
সড়কে বিশৃংখলতা, বাজারে সিন্ডিকেট, বিআরটিসি, পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্য, চাকরির প্রশ্নে দুর্নীতি, ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অবৈভাবে চাকরি আদায়, জমি দখল, গরিবরে হক নষ্ট করে আমরা যদি নিজেদের মানুষ দাবি করি তাহলে আমরা হলাম মূর্খ আর বোকা। আমরা যদি প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মে বিশ্বাসী হই তাহলে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। আজ হয়তো আপনি পার পেয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনি পালিয়ে যেতে পারবেন না। আপনি মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবেন, মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আপনি রেহাই পাবেন না। আর আপনি যদি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী না হন, তাহলে আপনার সেই হিসাব আপনাকে প্রকৃতি ফিরিয়ে দিবে, সময় ফিরিয়ে দিবে।
সর্বোপরি একটা দেশ সুন্দরভাবে গঠন করতে গেলে অমানুষের চাইতে মানুষের সংখ্যা বেশি প্রয়োজন হয়। চেয়ারে বসলে মানুষটাই যদি অমানুষ হয়ে যায় তাহলেও ভয় আছে। আর এভাবেই চলতে থাকলে দেশের কোনো উপকারই হবে না। তাই সবার আগে মানুষ হওয়া জরুরী। মানুষ হতে না পারলে দেশটা কখনওই সোনার হবে না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি