শ্রীলংকায় বামদের উত্থান, নেপথ্যে কী?
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৪২ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৪৫
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় একটি গণঅভ্যুত্থান হয়। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের তীব্র সংকটের প্রতিবাদে ২০২২ সালে সড়কে নেমে আসে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণ। প্রবল জনঅসন্তোষের মুখে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। তারপর একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ হাজারও জনতা ঢুকে পড়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনে। তখন গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরপর রণিল বিক্রমাসিংহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে দেশটির সংসদ। যদিও তখন তিনি জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি ছিলেন না।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় পর জনগণের ভোটে বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে রাষ্ট্রপতি হিশেবে পেয়েছে শ্রীলংকা। জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) প্রধান অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এবারের নির্বাচনে এনপিপি (বামপন্থী) জোটের প্রার্থী ছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর এবার সংসদ নির্বাচনেও বামপন্থীদের দাপট। শ্রীলঙ্কার ২২৫ সংসদীয় আসনের ১৫৯ আসনে জিতেছে রাষ্ট্রপতির অনূঢ়ার এনপিপি জোট; অর্থাৎ বামপন্থী জোট। দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য যা যথেষ্ট। ইতিহাস বলছে দেশটির অতীত রেকর্ডে এমনটা কখনও দেখা যায়নি। অথচ গত সংসদ নির্বাচনেও মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল এই বামপন্থী জোট। অবশ্য তখনই প্রথমবার অর্থাৎ ২০১৯ সালের নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে এই জোটের নির্বাচনে আসা তাদের। এই জোট তৈরিতে অনুঢ়ার ভুমিকা ছিল বেশ কার্যকরী। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৭তম জাতীয় কনভেনশনে তিনি জেভিপির নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন অনুঢ়া। ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন এনপিপি। তারপর নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে তার দল মাত্র তিন শতাংশ ভোট পায়। সেখান থেকে ঘুরে দাড়িয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলেন।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর থেকেই শ্রীলঙ্কা শাসন করেছে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট অথবা তাদেরই কোনও অংশ। এর মধ্যে একটি রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)। দলটি থেকে একাধিকবার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগের আগে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে। গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালানোর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেভিপির জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। সেই গণবিক্ষোভে সক্রিয়া ভূমিকা ছিল দলটির। আন্দোলনের পর জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করেছে। সেই সাথে দলের সঙ্গে বেড়েছিল অনূঢ়ার ব্যক্তিগত আবেদন।
তবে তাদের এই উত্থান হুটহাট করেই আসেনি। এতে তাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ইতিহাস আছে। যা এবারের বিপ্লবের পর জনগণের কাছে যথাযথভাবে কার্যকর হয়। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে মার্ক্সবাদে অনুপ্রাণিত দুটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল অনূঢ়ার দল জেভিপি। যদিও তা পরে ব্যর্থ হয়। তবে ২২ সালের অভ্যুত্থানের পর সেখানকার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে অনুঢ়ার দল। যার ফলপ্রসূ অনুঢ়াকে রাষ্ট্রপতির পর সংসদেও তাদের জোটকে বিপুল আসনে জয়যুক্ত করে শ্রীলঙ্কার জনগণ। এটাকে শ্রীলঙ্কার লাল বসন্তের দিন বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে এখন দেখার পালা সেখানে লাল বসন্তে কেমন কাটে জনগণের জীবনযাপন ও শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ, বা কতদিনেই টিকে থাকে বসন্ত।
শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশ। বিশ্বের ধার্মিক দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা তৃতীয়। তবে তাদের মধ্যে মৌলবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি এতোটা নেই। শিক্ষার দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে এগিয়ে। যার সাক্ষরতার হার ৯২% এবং ৮৩% মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের দেশে শিশুদের ৯ বছর মেয়াদি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সুতরাং তাদেরকে বলা যায় একটি শিক্ষিত রাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তারা অনেকটা কুসংস্কারের সংস্কার করতে পেরেছে বলেই দেখা যায়। তাই তারা বামপন্থীতে আস্থা রেখেছে, খুঁজে নিয়েছে সংকট থেকে মুক্তির পথ। এবং ২২ এর অভ্যুত্থানে অনুঢ়ার দলের সাহসী ভূমিকাই ছিল জনগণের বিজয়ের মূলমন্ত্র। যার ফলে এই অভ্যুত্থানের পর আজ শ্রীলঙ্কার বামপন্থী এনপিপি জোটের উত্থান সম্ভব হয়েছে।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই