Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রবাসীর সাহিত্য আড্ডায় বিপ্লবের খোঁজ

আবু মকসুদ
২২ আগস্ট ২০২৪ ১৮:৪১ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৪৫

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমী গত তিন বছর ধরে সাহিত্য উৎসব এবং আড্ডার আয়োজন করে আসছে। এ বছরও আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছিল—হল ভাড়া, খাবারদাবার অর্ডার, শিল্পী বাছাই, এবং দাওয়াতের সব আয়োজনও আমাদের ছিল। কিন্তু সবকিছুর কান্ডারি নুরুল ভাই (নুরুল হক) হঠাৎ দেশে চলে গেলে, এবং স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার পাঞ্জায় পড়ে তার ফিরে আসা অনিশ্চিত হয়ে গেলে, আমরা উৎসব স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিই। তার অনুপস্থিতিতে কোনো কিছুই পূর্ণাঙ্গ হবে না, তাই অনুষ্ঠান করার ঝুঁকি নিতে চাইনি।

বিজ্ঞাপন

তবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চিন্তা করে, সীমিত আকারে আড্ডার আয়োজনের ব্যাপারে সবাই একমত হই। এই লক্ষ্যে গত ২০ আগস্ট আমার ঘরে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করেছিলাম। সেন্ট অ্যালবান্স, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, লিডস থেকে বেশ কয়েকজন বন্ধু আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন।

এটা মূলত সাহিত্য আড্ডা ছিল, কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল নিয়েও কথা বলতে। বার্মিংহাম থেকে এসেছিলেন তাত্ত্বিক এবং গবেষক মনোওয়ার আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ, কবি-সম্পাদক সৈয়দ মাসুম, কবি-সংগঠক সৈয়দ ইকবাল, এবং বাচিক শিল্পী-উপস্থাপক নোমান আল মনসুর। ম্যানচেস্টার থেকে এসেছিলেন কবি রসুল বকুল এবং কবি ম. আ. মুস্তাক। লিডস থেকে এসেছিলেন কবি সৈয়দ আনোয়ার রেজা এবং টি এম কায়সার আহমদ। সেন্ট অ্যালবান্স থেকে এসেছিলেন আমার বাল্যবন্ধু ইকবাল আহমদ। আরও উপস্থিত ছিলেন শেফিল্ডের পরিচিত মুখ রাজনীতিবিদ মতিউর রহমান শাহীন, সংস্কৃতি কর্মে বিশ্বজিৎ দেব এবং শেফিল্ড সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি আহমদ হোসেন হেলাল।

আড্ডা ক্ষুদ্রাকারে হলেও প্রাণবন্ত ছিল। প্রাণবন্ত হওয়ার কারণ ছিল দুজন ব্যক্তি—মনোওয়ার আহমদ এবং টি এম কায়সার। এই দুজনের অসাধারণ পাণ্ডিত্য, যে কোনো বিষয়ের যুক্তি এবং ব্যাখ্যা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। আড্ডায় আমরা বিচিত্র বিষয় নিয়ে কথা বলেছি—রাসূল (সাঃ) প্রাক-ইসলামী যুগের কবি ইমরুল কায়েস, ওয়েস্ট ল্যান্ডের কবি টি এস এলিয়ট, আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’—এমন কোনো বিষয়ই আমরা বাকি রাখিনি।

বিজ্ঞাপন

সাহিত্যের ফাঁক-ফোকর গলে আমরা কখনো ফিরে গেছি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদ্মায় চুবানো ডক্টর ইউনুস প্রসঙ্গে, কিংবা ছাত্ররা যেভাবে কলেজে কলেজে প্রিন্সিপালদের কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে, এবং আন্দোলনের সাফল্যে নিজেদের জন্য অটো পাশ নিশ্চিত করছে—এগুলো বিপ্লবের সাথে কতটুকু সংশ্লিষ্টতা রাখতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতও ব্যক্ত করেছেন অনেকে।

আমরা আলোচনা করেছি বিপ্লব-উত্তর সাহিত্য নিয়ে। এই বিপ্লবে সাহিত্যের কতটুকু উন্নতি সাধন হবে? বিপ্লব কি সাহিত্যে নতুন কোনো দিক-নির্দেশনা দিতে পারে? গণজাগরণের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কী থাকে? অতীতের গণজাগরণ থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিয়েছি? যদি না নিয়ে থাকি, তাহলে এই গণজাগরণকে এত উচ্ছ্বাস ভরে দেখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না?

আমরা সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছি বাংলাদেশের গণজাগরণকে কেন্দ্র করে আমাদের লেখক সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে। আমরা প্রশ্ন করেছি একজন লেখকের প্রথমে কি হওয়া প্রয়োজন? এখানে উপস্থিত সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে একজন লেখকের প্রথমত মানুষ হওয়া প্রয়োজন। সবাই ‘মানুষ’ শব্দটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘মানুষ’ কী, তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কবি ও সংগঠক টি এম কায়সার আহমদ, যিনি বহির্বিশ্বে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে পরিচিত করার জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।

মানুষ নিয়ে তার ব্যাখ্যায় আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি এবং একমত হয়েছি যে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা দেখে যে নিশ্চুপ থাকে, কিংবা যে ব্যক্তি কোনো যুক্তি ছাড়াই মানুষের বিপরীতে অবস্থান করে, সে কখনো কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না।

যদিও কারো দাবি করা-না করা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, তবু স্বীকার করতেই হবে, কোনো কবি যদি স্বৈরাচারের গুণকীর্তন বা স্বৈরকর্মকে নানান অজুহাতে আড়াল করতে চায়, সেটাও তার স্বাধীনতা। তবে ইতিহাস স্বৈরাচার চিনতে ভুল করে না, এবং স্বৈরাচারের দোসরদেরও ইতিহাস চিহ্নিত করতে পারে এবং করেছে।

আড্ডা শুরু হয়েছিল বিকেল চারটা থেকে। হঠাৎ সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত বারোটা হয়ে গেছে। যারা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিলেন, তাদের ফিরতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসন ছাড়তে বাধ্য হলেন তারা। কিন্তু কবিতা শেষ মুহূর্তেও এসে বাগড়া দিল। আমাদের প্রত্যেকের পকেট ভরা ছিল কবিতায়, মোবাইল স্ক্রিনে কবিতা দেখে দেখে যখন নিজেদের কবি হিসেবে জাহির করছি, তখন কেউ হঠাৎ মোবাইলে হেলমেট পরিহিত দীপু মনিকে দেখান। আমরা অজস্র কবিতা লিখতে পারবো, কিন্তু দীপু মনির হেলমেটে যে কবিতা উৎকীর্ণ আছে, হাজার চেষ্টা করেও কয়েকজন প্রতিভাবান কবি মিলেও এমন কবিতা লিখতে পারবেন না…

আড্ডা শেষ হয়েছিল, কিন্তু সেই আলোচনা এবং সৃজনশীল ভাবনাগুলো আমাদের মননে গেঁথে থাকে। কবিতা, রাজনীতি, এবং সমাজ নিয়ে আমাদের কথোপকথন আমাদের চিন্তার জগৎকে আরও প্রসারিত করেছে। বিদায়ের সময় সবাই মনের মধ্যে একটি অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম—একদিন এই আলাপ আবারও হবে, যেখানে নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এবং নতুন বিপ্লবের গল্পগুলো স্থান পাবে।

২.

আমরা, ব্রিটেনে বসবাসরত মুক্তিকামী বিপ্লবীরা, দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে তুমুল কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলাম। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দুর্ধর্ষ স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের শাসনভার হাতে রেখে স্বৈরাচারী শাসন চালাচ্ছিলেন, তাকে আমরা ফেসবুকের তলোয়ার দিয়ে ধাওয়া করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করি। অবশেষে, আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলস্বরূপ, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। বিপ্লব সফল হলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ফেসবুক বিপ্লব সাময়িকভাবে স্থিমিত হয়ে যায়, এবং আমরা কিছুটা স্বস্তি অনুভব করি।

বিপ্লবের সাফল্য উদযাপনের জন্য আমাদের মধ্যে নতুন স্বাধীনতার সৈনিকেরা একত্রিত হওয়ার পরিকল্পনা করি। একে অপরকে বাহবা দেওয়ার জন্য আমাদের মনের মধ্যে একধরনের আগ্রহ জন্ম নেয়। যেহেতু আমি ছিলাম এই নতুন স্বাধীনতার নতুন সৈনিকদের সেনাপতি, তাই স্বাভাবিকভাবেই পিঠ চাপড়ানোর দায়িত্বটা আমার ঘাড়েই এসে পড়ে। গত ২০শে আগস্ট আমাদের নতুনভাবে স্থাপিত ক্যান্টনমেন্ট, যা শেফিল্ডের ডারনেল এলাকায় অবস্থিত, সেখানে স্বাধীনতা উদযাপন এবং পিঠ চাপড়ানোর অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান অতিথি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্যও আমারই হয়।

আড্ডার আমরা সবাই

আড্ডার আমরা সবাই

দেশের আনাচে-কানাচে ফেসবুকের বিভিন্ন ফ্রন্টে যারা অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেছেন, তারা সবাই এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তারা একে একে আমাকে বাহবা দিতে থাকেন, অসংখ্য বাক্যে আমাকে ‘মারহাবা’, ‘ব্রাভো’, ‘জিও’ ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করেন। এত খেতাব ও প্রশংসার জোয়ারে আমার হৃদয় প্রশস্ত হয়ে ওঠে, মনের মধ্যে একধরনের অহংকার জন্ম নেয়। একসময় মনে হতে থাকে, হয়তো আমিই শেখ হাসিনার মতো ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছি! আমার ভেতরের স্বৈরাচারী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, নিজেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার স্থানে কল্পনা করতে থাকি। আমার এমন রূপান্তর দেখে সহকর্মীরাও আশ্চর্য হয়ে যায়।

কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় কল্পনার চেয়েও কঠিন হয়। যখন আমার দুর্ধর্ষ স্বৈরাচারী রূপান্তরটা পুরোপুরি মাথায় চড়ে বসেছে, তখন আমার ঘরের দুনিয়ার স্বৈরাচার, অর্থাৎ আমার স্ত্রী, আমাকে উপরে ডেকে নিয়ে যান। তিনি আমাকে কঠোরভাবে ধমক দেন এবং স্বৈরাচার হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। বাইরের দুনিয়ায় আমি যতই বীর আলেকজান্ডার হিসেবে খ্যাতিমান হই না কেন, ঘরের দুনিয়ায় আমি একদমই সাধারণ ছাপোষা বাঙালি। স্ত্রীর ভয়ে ভীত হয়ে আমি দ্রুতই নিজের স্বৈরাচারী স্বপ্নগুলোকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হই।

এরপর যখন ঘরে ফিরে আসি, তখন উপলব্ধি হয় যে বাইরের দুনিয়ায় যতই গর্জন করি না কেন, আসল কর্তৃত্বটা কার হাতে। এমনকি ফেসবুকের যুদ্ধে জয়ী হলেও, ঘরের যুদ্ধটা সবসময়ই কঠিন। তাই আমি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করি—এবার আমার লক্ষ্য শুধুই ঘরের শান্তি রক্ষা।

আমাদের বিপ্লবী যোদ্ধারাও এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেন। তারা বুঝতে পারেন, যে স্বৈরাচার বাইরের দুনিয়ায় পরাজিত করা যায়, ঘরের মধ্যে তার সঙ্গে সমঝোতা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এভাবে আমরা বুঝতে পারি, ফেসবুকের বিপ্লব আর ঘরের বিপ্লব এক নয়, এবং দুটির মধ্যে স্পষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। ফলে, আমাদের উদযাপন স্থগিত হয়ে যায় এবং সবাই নিজ নিজ ঘরে ফিরে যায়, ভবিষ্যতে আবারও ফেসবুকের মাঠে নামার সংকল্প নিয়ে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবু মকসুদ প্রবাসীর সাহিত্য আড্ডায় বিপ্লবের খোঁজ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর