আই হেট পলিটিক্স ও অনাগত ভবিষ্যত
৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২৮
রাজনীতি একপ্রকার ব্যবহারিক বিজ্ঞান। একটি দেশের সমস্ত কিছুর চালনাশক্তি প্রক্রিয়া অবশ্যই রাজনৈতিক কাঠামোতে আবদ্ধ। প্রায়শই শোনা যায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে পণ্য দ্রব্যর দাম পরিবর্তন হবার কথা। বাস্তবিক অর্থে রাজনীতি যেকোন রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক। রাজনীতি ব্যাতীত কোন রাষ্ট্র সুপথে চলতে পারে না তবে সেই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা সুস্থ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশ রাজনীতির ফসল কথাটি আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি কথা। অসত্য নয় বরং নির্মম সত্যি তো এটাই৷ হাজারো বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জন্ম নিয়েছে এই জন্মভূমি। বাঙালির হাজার বছরের শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামের সমস্ত সাহসের ঐক্যবদ্ধ রূপ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ স্বাভাবিক ভাবেই বলা যাচ্ছে যে, হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে রাজনীতির এক প্রকার সূক্ষ্ম ও প্রাসঙ্গিক মেলবন্ধন বিদ্যমান। স্বাধীনতার সংগ্রামের আন্দোলনে চোখ রাখলেও সেই একই প্রেক্ষাপট পরিলক্ষিত হবে। দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের। সাধারণ জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সৃষ্টি করেছে মহাকালের মহাকল্লোলের। যার আভিধানিক নাম মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি সাধারণ ছাত্র সমাজকেও গর্জে উঠতে দেখা গেছে মহানমুক্তিযুদ্ধে। সেখানেও ছাত্ররাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্ররাই ছিল সামনের সারিতে। তখনকার দুই জ্বালাময়ী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে। ছাত্রলীগ বিজয় ছিনিয়ে আনতে সৃষ্টি করে মুজিব বাহিনীর। একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যাদের প্রায় ১৭ হাজার পূর্বসূরী মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়৷ ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য বাম সংগঠনের মতামত অনুযায়ী তাঁদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৬ কিংবা ৯ হাজার।
মূল প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক, বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই রাজনীতিকে স্রেফ ঘৃণার নজরে ভাবে। অথচ নব্বইয়ের দশকেও দৃশ্যপট এমনটা ছিলো না৷ ক্লাসের বা বিভাগের সবচাইতে মেধাবী শিক্ষার্থীটিই জড়িত থাকতো কোন না কোন ছাত্রসংগঠনের পতাকাতলে। একজন মানুষ রাজনীতি না করলে সেটা কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না বরং পুরোপুরি রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন হয়ে গেলে বিষয়টি পুরোপুরি চিন্তার। রাজনীতি জ্ঞান শূন্য বা রাজনীতি বিমুখ এই তরুণ প্রজন্ম কোনভাবেই জাতির জন্য আর্শীবাদ বয়ে আনবে না৷ রাজনৈতিক সচেতনতার চাইতে ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চা, ক্রীড়াবিমুখকতা, মাদকাসক্ত হওয়া এসবে আকৃষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। অনেকে বলতে পারেন রাজনৈতিক ছত্রছায়াতে বিপথগামীরা এসব পথকে সুগম করে। এক্ষেত্রে আসলে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই। আজকের এই ‘আই হেট পলিটিক্স’প্রজন্ম একদিনে জন্ম নেয় নি। রাজনৈতিক নৈরাজ্য, অপরাজনীতি, সুস্থ পরিবেশের অভাবেই তরুণ প্রজন্ম অনেকাংশে বাধ্য হচ্ছে আই হেট পলিটিক্স বলতে। অন্যদিকে প্রগতিশীলতা বিরোধী দেশদ্রোহী চক্রগুলো নিজেদের সুবিধার্থে রাজনৈতিক দূরাবস্থাকে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে নিজেরা ফায়দা লুটছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচাইতে মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান খ্যাত বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে আলোচনা সমলোচনা বয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ সরাসরি সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের নামকে সামনে আনছে কেউবা শুধুমাত্র পড়াশোনার পরিবেশের কথা ভেবেই রাজনীতি চাচ্ছে না। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক নানা দূরাবস্থার মাঝে হয়তো খারাপ একটি কালো ছায়া এসেছে ছাত্র রাজনীতির উপর। এটা অসত্য নয় বরং নিখাঁদ সত্যি বটে। রাজনৈতিক দূরাবস্থা বা ছাত্ররাজনীতি নিষেধ থাকার অর্থ একদমই রাজনৈতিক কার্যকালাপ বন্ধ রাখা। যেটা একদমই সম্ভবপর হয় নাই বুয়েটে। প্রথমত, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে কমিটি করলো৷ ছাত্র শিবির, জঙ্গি সংগঠনগুলো বারংবার কার্যক্রম চালাচ্ছে। দেশের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ও বিশিষ্টজনদের কথায় সেটা বারবার সামনে এসেছে।আবরার হত্যাকান্ডের বিচার হলো, ছাত্রলীগ সরাসরি অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে। দূর্ভাগ্যবশত সনি ও দীপ একই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী হলেও তাঁদের ক্ষেত্রে এমনটা কখনোই দেখা যায় নি। বাস্তবিকভাবে একটি ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত। আবরারের প্রশ্নে যে মহলটি সোচ্চার ঠিক দীপের প্রশ্নে তারা নিশ্চুপ। হয়তো দীপ ছাত্রলীগ করতো কিংবা মুজিব আদর্শের সৈনিক ছিল বলেই৷ একজন শিক্ষার্থী হত্যা নিশ্চয়ই গুরুতর ও ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ। অপরাধ হলে বিচার হবে নিরপেক্ষতার সহিত এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বরাবরই বিচারের প্রশ্নে আপোষহীন তখন অযথা প্রশ্ন তুলে জল ঘোলাটে করা নিশ্চয়ই অনুচিত কর্ম৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দোষের কিছু নাই। কেননা, সানি ও দীপের ইতিহাস থেকেই হয়তো তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু যারা আবরাবের লাশকে রাজনৈতিক উপকরণ বানিয়েছে তাদের কে কতোটা সুস্থ বলবেন? পাবলিক সেন্টিমেন্ট স্বাভাবিক ভাবেই পেয়েছে ফলশ্রুতিতে পিছনে তাকাতে হয়নি৷ নিঃস্বার্থ ভাবে সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালে বিষয়টা মানানসই হতো। আরো বাস্তবিক হতো যদি দীপের প্রশ্নেও দাঁড়াতো। দীপ কি জাতির সম্পদ নয়? নাকি ছাত্রলীগ করাই এদের দৃষ্টিতে ছিল অপরাধ।
এখনকার ছাত্রলীগ সভাপতি বুয়েটে প্রবেশ করলো ফলশ্রুতিতে সেটিকে সামনে এনে একদল শিক্ষার্থী আন্দোলনে হাজির৷ ইমতিয়াজ রাব্বি নামক একজন শিক্ষার্থীর সিট বাতিল করা হলো আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। তাঁর অপরাধ ছাত্রলীগ করে। সাময়িক বহিষ্কার টাও করে ফেললো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অদ্ভুত হলেও সত্যি! আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দাবি করলো ৬ টি বিষয় সম্পর্কে। যেখানে মূল এলার্জি ছিল ছাত্রলীগ নিয়ে৷ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় থাকলেও সে বিষয়ে একফোঁটা মন্তব্য তাদের ছিলো না। অভিযোগের তীর পুরোটাই ছিল ছাত্রলীগ কেন্দ্রিক। আবরারের ঘটনার সুবাদে খুব সহজেই ছাত্রলীগ বিদ্বেষী একটি বিরাট গোষ্ঠী নিশ্চিত করতে পেরেছে তথাকথিত সংগঠনগুলো। যেটার পুরোটাই আবেগকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করে। অন্যথায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনোই এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নিতো না। মুখে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বললেও বস্তুত সেটি ছিল ছাত্রলীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার একটা মহড়া মাত্র। যেখানে আবরার হত্যাকান্ডে সরাসরি ছাত্রলীগ খুনীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো কিংবা রাজনৈতিক সাহসিকতা দেখালো সেখানে বারংবার সামনে বিষয়টি টেনে আনা অযৌক্তিক নয় কি? আর আনলেও সনি, দীপের নাম গন্ধ নাই কেনো?
২০১৯ থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। অথচ ২০২২ সালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী পণ্ড করে দেয়।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকার পরেও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর ও যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী সংগঠন শিবিরের তৎপরতা নিয়ে কথিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোন কথা নেই?
২০২৩ সালে সুনামগঞ্জের হাওরে আটক, নাশকতার মামলার আসামি ৩১ শিবিরকর্মীর বিচার বিষয়ে তথাকথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিছু কথা নেই। জঙ্গি হিসেবে গ্রেফতার হওয়া এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শ্রেণীকক্ষে একই সঙ্গে ক্লাস করতে আপত্তি নাই কেন? নাকি কারো অদৃশ্য ইশারাতে চালিত হচ্ছে তথাকথিত
আন্দোলন?
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার মূল কারণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিচালনা। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। অথচ বুয়েটে ছাত্রশিবিরের কমিটি রয়েছে। তারা সাংগঠনিক কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। সেসব কর্মকাণ্ডের ছবি পাওয়া গেছে হাওরে আটক বুয়েট শিক্ষার্থীদের মোবাইলে।
বুয়েটে রাজনীতি বন্ধ, একই সাথে সাংস্কৃতিক তৎপরতাও স্থবির। শুধু চলছে সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম।
সাম্প্রতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের বড় একটা অংশ রাজনীতি বিমুখ একথা অকপটে মানতেই হবে। রাজনীতি বিমুখ আর কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি বিদ্বষ বা সেরূপ পরিবেশ সৃষ্টি অবশ্যই এক কথা নয়। বাংলাদেশের আইন তথা সর্বোচ্চ আইন মানলে সংগঠন করার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং বিশেষ অবস্থা বা জরুরি অবস্থা ছাড়া এটাকে সীমিত বা নিষিদ্ধ করার সুযোগ নেই ( অনুচ্ছেদঃ ৩৮)।
বিষয়টি খুব স্বাভাবিক যে এক্ষেত্রে বুয়েটে ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লুটা হচ্ছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। পুরোপুরি রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন এই প্রজন্ম নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের কর্মে। অরাজনৈতিক হওয়া অপরাধ নয় তবে রাজনৈতিক ভাবে অসচেতনতা নিশ্চয়ই মানসিক অসুস্থতা তথা অদূরদর্শীতার ই শামিল। নিরপেক্ষ ভাবে ভাবলে শুধু ছাত্রলীগ নয় বরং দেশের অন্য ছাত্রসংগঠন গুলোও মেধাবী নেতৃত্ব পেতে পারে এই বুয়েট থেকে। তবে সেটা শুধু জঙ্গিগোষ্ঠী গুলো ও শিবিরের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? সঙ্গত কারণেই বলা যায় যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়াশেই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন। এদেশের সোনালী অতীত ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ধারাকেই ইঙ্গিত করে। বিভিন্ন সময়ে এদেশীয় দেশদ্রোহী দোসররা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে রাজনীতির সৌন্দর্যকে। ধরে নিলাম, রাজনীতি না থাকলে যদি ভালো হয় তবে ভালোই। কিন্তু এই সুযোগে জঙ্গিবাদের উন্থানকে কখনোই সমর্থন করা যায় না। অতএব, জঙ্গিবাদ রুখতেই নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন।
তাছাড়া, বুয়েট প্রশাসনের কি উচিত নয় যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া৷ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই যেখানে জঙ্গিবাদ দমনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সোচ্চার সেখানে বুয়েট কেন জঙ্গিবাদের ঘাঁটি হবে? এটা লজ্জার নয় কি? দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেশকে দেবার মতো বহু কিছু আছে।
ছাত্র রাজনীতি তাঁদের সেই যোগ্যতাকে পরিশীলিত করবে, সাংগঠনিক সক্ষমতা বা ম্য্যনেজিং ক্যাপাবিলিটি বাড়াবে।
এদেশের অতীত ইতিহাসের সাথে ছাত্র রাজনীতির সোনালী অতীত জড়িত। নোংরা ছত্রছায়ায় পঁচাত্তর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে কলুষিত হয়েছে এদেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই ধারাবাহিকতার কালো ছাপ স্পষ্ট আজো। তাই বলে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার বির্ণিমানের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে? এতে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। রাজনীতি অপছন্দ করলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত তরুণ প্রজন্মের। এরাই তো ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বাস্তবতা এটাই যে, আই হেট পলিটিক্স এর অনাগত ভবিষ্যৎ সেতো অন্ধকার বৈকি আলো নয়। জন্মভূৃমি বাংলাদেশ আলোকিত হোক। জঙ্গিবাদ নিপাত যাক, বাংলাদেশ মুক্তি পাক।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস