শহীদুল্লা কায়সার: আজও যার শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে স্বদেশ
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:২৪
১৬ ফেব্রুয়ারি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের জন্মদিন। ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। শহীদুল্লা কায়সার নামে লেখালেখি করতেই বলেই এ নামে তিনি সমধিক পরিচিত। তার পিতার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মাতার নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে শহীদুল্লা কায়সার সরকারি মডেল স্কুলে এবং পরে মাদরাসা-ই-আলিয়ার অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শেষ করেননি।
একই সাথে তিনি রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তার বাবা ঢাকায় চলে আসেন এবং শহীদুল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তবে এ ডিগ্রি লাভ করার আগেই লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটান।
শহীদুল্লা কায়সার একাধারে ছিলেন রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। মাত্র ১৪ বছরে বয়সে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবে রাজনীতিতে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে। এরপর ৪ বছরের মধ্যে অর্থাৎ, ১৯৫১ সালে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং পরবর্তীতে পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
শহীদুল্লা কায়সার সাংবাদিকতার প্রবেশ করেন মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার মধ্য দিয়ে। তখন ইত্তেফাক সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে বের হতো, যার প্রতিষ্ঠা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। শহীদুল্লা কায়সার ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক পরিক্রমা’ ও ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে ‘বিচিত্রা কথা’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। তার আপসহীন এসব লেখায় ফুটে উঠতো শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালির অধিকারের কথা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বিচারে তাকে সাড়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদের মধ্যেই তিনি আবার গ্রেফতার হন।
১৯৫৮ সালে কারাগার থেকে আবার মুক্তি মিললে শহীদুল্লা কায়সার দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু ওই বছরের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে জননিরাপত্তা আইনে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় তৎকালীন আইয়ুব সরকার। এরপর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন প্রায় ৪ বছর পরে ১৯৬২ সালের অক্টোবরে। ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়ে পুনরায় দৈনিক সংবাদ-এ যোগদান করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্তর্ধান পর্যন্ত এখানেই যুক্ত ছিলেন।
শহীদুল্লা কায়সারের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারের প্রকোষ্ঠে। তিনি সেখানেও সময় ও জীবনকে সৃজনশীলতায় ব্যয় করেছেন। কারাগারে থাকাকালীন সবসময়ই তার কাছে ডায়েরি থাকতো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন তিনি রাতভর লেখালেখি করতেন। জেলখানায় বসেই লিখে ফেলেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘সারেং বউ’। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের এক মাস পরেই ১৯৬২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হলো তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘সারেং বউ’। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আইয়ুব আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন, আর আমি হয়ে উঠেছি সাহিত্যিক। ‘সারেং বউ’ ছাড়াও তার অন্য দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ ও ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’ও তিনি জেলখানায় বসেই লিখেছিলেন।
১৯৭১ সালের ভয়াল ২৫ শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে যখন পাকহানাদার বাহিনী বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তখন তৎকালীন অনেক কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শহীদুল্লা কায়সার দেশ ছাড়েননি। রুটিন মাফিক কাজ করে যাচ্ছিলেন দৈনিক সংবাদ-এর অফিসে। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী দৈনিক সংবাদ-এর অফিস পুড়িয়ে দিলো। এসময় অনেকেই শহীদুল্লা কায়সারকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। অনেকে বললেন, এই মুহূর্তে দেশে থাকা আপনার উচিত নয়। আপনি ভারতে চলে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসবেন। ওরা কাউকেই রাখবে না। তিনি নিজেও শুনেছিলেন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা। কমরেড মনি সিংহ তাকে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে তোমার থাকা আর ঠিক না। ভারত থেকেও কাজ করা যাবে। জবাবে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘সবাই যদি চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে? আর এই তথ্যগুলো আমার উপন্যাসের কাজে লাগবে।’
শেষমেশ তিনি দেশেই রয়ে গেলেন। শহীদুল্লা কায়সারের সহধর্মিণী পান্না কায়সারের লেখা ‘একাত্তরের শহীদ: শহীদুল্লা কায়সার’ গ্রন্থ ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের (৮ম খণ্ড) তথ্যসূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মধ্যে যখন তিনি ঢাকার বাইরে থাকতেন তখন রেশনকার্ড দিয়ে যেতেন কবি সুফিয়া কামালের কাছে। কবি সুফিয়া কামাল রেশন কার্ড দিয়ে জিনিসপত্র তুলে আনতেন আর শহীদুল্লা কায়সার ঢাকায় ফিরে সেই জিনিসপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিলিবন্টন করতেন। কেবল তাই নয়, তার বাসাও ছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দেওয়া হতো।
১০ ডিসেম্বর থেকে যখন পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী নিধন পূর্ণ মাত্রায় শুরু হয়ে গেল তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন তার পরিবার। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে উঠিয়ে নিয়ে গেল আলবদর বাহিনী। ঠিক এক ঘণ্টা পরেই পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হককে পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ও ভোর ছয়টার দিকে দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল। ১২ ডিসেম্বর আলবদরের বেশ কয়েকজন তরুণ পিপিআইর জেনারেল ম্যানেজার ও বিবিসির প্রতিবেদক নিজামউদ্দিন আহমেদকে পুরান ঢাকার কলতাবাজারের তার বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ১৩ ডিসেম্বর শহীদুল্লা কায়সার পরিবারের চাপে নিরাপত্তার জন্য বাসা ছাড়তে বাধ্য হলেন। তিনি ভাবলেন ঢাকাতেই কোথাও আত্মগোপনে থাকবেন। কিন্তু বাসা ছাড়ার আধঘন্টা পর তিনি ফিরে এলেন। স্ত্রী পান্না কায়সারকে বললেন, ‘আমি একা থাকবো না। তোমাদের নিয়ে একসাথে থাকবো!’
এদিন রাতে খাওয়ার পর স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখলেন শহীদুল্লা কায়সার। চিঠির ভাষাটা এমন ‘প্রিয়তমা সুপান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।’
১৪ ডিসেম্বর। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে। পুরান ঢাকার কায়েতটুলির বাসায় শহীদুল্লা কায়সার মোমবাতি জ্বালিয়ে বিবিসি শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন তার স্ত্রী পান্না কায়সার শিশু কন্যা শমী কায়সারকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। শহীদুল্লা কায়সারের ছোট ভাই ওবায়দুল্লা এসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললেন, ‘বড়দা দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে খুলে দেব?’
শহীদুল্লা কায়সার ভাবলেন কোনো মুক্তিযোদ্ধা হবে। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা হবে। জলদি দরজা খুলে দে।’ তিনি নিজেও আলমারি খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগৃহীত অর্থ গুণতে লাগলেন। কিন্তু না। কালো কাপড়ে মুখ জড়ানো চার পাঁচ জন তরুণ এসে বললো, ‘শহীদুল্লা কায়সার কে?’ জবাবে শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘আমিই শহীদুল্লা কায়সার। কী দরকার বলুন?’
তখন একজন বলল, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে একটু’ বলে তাকে ধরলো। এর মধ্যে শহীদুল্লা কায়সারের বোন ও স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? জবাবে তরুণরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, ‘ তাকে কিছুক্ষণ পর আমরা ছেড়ে দেবো।’
কিন্তু সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না শহীদুল্লা কায়সার। যাওয়ার আগে শুধু একবার হালকা গলায় বললেন ‘ভালো থেকো।’ বাইরে তখন কারফিউ চলছে, গভীর অন্ধকারে ধীরে ধীরে তাকে বহনকারী গাড়িটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর ফেরা হলো না শহীদুল্লা কায়সারের। ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ চিহ্নিত করা গেলেও আজও পাওয়া যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের লাশ। বড়ভাইকে খুঁজতে গিয়ে এভাবে আর ফিরে আসেননি বাংলাদেশের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান। এই দুই সহোদরের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি লাল-সবুজের স্বাধীন বাংলাদেশে। এক শহীদুল্লা কায়সার ও জহির রায়হানকে হারিয়ে আমরা অনেকে পিছিয়ে গেছি। যে ক্ষতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে স্বদেশ।
১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক সোনালী বিকেলে শহীদুল্লা কায়সার ও পান্না কায়সার যুগলবন্দী হন। শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সার নামে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। পান্না কায়সার একজন শিক্ষাবিদ ও লেখিকা, শমী কায়সার খ্যাতিমান অভিনেত্রী। শহীদুল্লাহ কায়সার তার বর্ণিল জীবনের জন্য উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এগুলো হলো- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৮৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৮)।
শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক। রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার কোথাও শহীদুল্লা কায়সার আপস করেননি। তার আপসহীন বর্ণাঢ্য জীবন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তথ্যসূত্র:
পান্না কায়সারের গ্রন্থ ‘একাত্তরের শহীদ: শহীদুল্লা কায়সার’
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (৮ম খণ্ড)
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন মুক্তমত শহীদুল্লা কায়সার: আজও যার শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে স্বদেশ