Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালাম কেন অনুসরণীয় অনুকরণীয়

ইমরান ইমন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৩১

প্রখ্যাত সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ও দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের সাবেক সম্পাদক আবদুস সালামের ৪৭তম প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯১০ সালের ২ আগস্ট ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুন্সীবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

আবদুস সালাম ফেনী সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে আইএসসি, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩১ সালে ইংরেজিতে বিএ (অনার্স) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এর জন্য তিনি “টনি মেমরিয়াল” স্বর্ণপদক পান। ফেনী কলেজের লেকচারার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে আবদুস সালাম প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর সরকারের আয়কর বিভাগ, সিভিল সাপ্লাই দপ্তর ও অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তুখোড় মেধাবীছাত্র আবদুস সালাম সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আবদুর রশিদ লিখেছেন, “আবদুস সালাম শুধু সাহিত্যের পাঠকই ছিলেন না; ছিলেন কোমল মনের অধিকারী, আবেগপ্রবণ একজন সমাজ ও স্বজাতি সচেতন ব্যক্তিত্ব।”
আরেক খ্যাতনামা প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল ওহাব লিখেছেন, “এ দেশের ভালো মাথার অধিকারীদের মধ্যে সালাম একজন। আবদুস সালাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র থাকার পরও প্রচণ্ড ভালোবাসতেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে।”

সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত (১৯৭৬) আবদুস সালাম ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাবরণকারী সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি পাকিস্তান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি, সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বাঙালি কর্মকর্তাদের নিপীড়নের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালে সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়ে আবদুস সালাম তৎকালীন সবচেয়ে অনিরাপদ পেশা সাংবাদিকতাকে বেছে নেন, যোগ দেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ৩ জুন তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন।

তখন ভাষা আন্দোলনের টালমাটাল সময়। এ সময়েই তিন মহারথী সম্পাদক আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যে গভীর সখ্য তৈরি হয়। এ আন্দোলনে অবজারভার ও অবজারভার সম্পাদকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। লেখালেখির মাধ্যমে পত্রিকাটি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করায় এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভারে জোরালো সম্পাদকীয় প্রকাশ করলে ওই দিনই পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয় এবং আবদুস সালামকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে ফেনী (উত্তর) আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সরকার অবজারভার প্রকাশের অনুমতি দিলে এর সম্পাদনায় আবার নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সংবাদপত্র-সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময়ে ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট’-সহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সমালোচনামূলক একটি সম্পাদকীয় লেখায় অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম। আবদুস সালামকে কারাগারে নেওয়া হয় কিন্তু তিনি তাতে এতটুকু বিচলিত ছিলেন না। ষাটের দশকে ফের কারাগারে যান আইয়ুব সরকারের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লিখে। ১৯৭২ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের হস্তক্ষেপ মেনে না নিয়ে মতবিরোধের জেরে অবজারভারের সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’ নামে গঠনমূলক সমালোচনা করে সাহসী সম্পাদকীয় লিখে তৎকালীন মুজিব সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে রোষানলে পড়েন। এরপর তাকে অবজারভারকে থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের “প্রভু নয় বন্ধু” গ্রন্থে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থা সঠিকভাবে ও সত্যিকারঅর্থে প্রতিফলিত হয়নি বলে আবদুস সালামই প্রথম এর বিরুদ্ধে জোরালোকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীন দেশেও সম্পাদকীয় লিখে জেলে যেতে হয়েছে আবদুস সালামকে, যা আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়।

যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে ১৯৫৪ সালে আবদুস সালাম পূর্ব-পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৭২ সালে অবজারভার ত্যাগ করতে তিনি বাধ্য হন। ১৯৭৬ সালে তার পরামর্শে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ প্রেস ইসস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক নিযুক্ত হন আবদুস সালাম। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে আপসহীন সম্পাদক সাংবাদিকতার বাতিঘর আবদুস সালাম মৃত্যুবরণ করেন।

দীর্ঘ ২২ বছর তিনি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে প্রমাণ করেছেন নিজের যোগ্যতা, সততা আর সর্বাবস্থায় কী করে সত্য প্রকাশ করতে হয়, কীভাবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হয়, কীভাবে মেরুদণ্ডসম্পন্ন সম্পাদক হতে হয়। তখনকার ভঙ্গুর সাংবাদিকতাকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। যা আজও উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে মনে রাখেনি। এমনকি তার জন্ম ও মৃত্যুদিবসটুকুও ওভাবে পালিত হয় না।

আবদুস সালামের সাংবাদিকজীবন পর্যালোচনা করে দেখা হয়, সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন আপসহীন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ছিল যার ব্রত। কোনো প্রকার শক্তি ও ক্ষমতা তাকে তার সত্যের পথ থেকে, নিরপেক্ষ ও আপসহীনতার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সাংবাদিকতাকে তিনি প্রকৃতঅর্থে ধারণ করেছিলেন। যার ফলে তাকে জেলজুলুম খাটতে হয়েছে জীবনভর। কিন্তু তিনি তার আদর্শ থেকে এক চুলও নড়চড় করেননি। বর্তমানে আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে কি এমন আদর্শ দেখা যায়? আমাদের বর্তমান সাংবাদিকরা কি আবদুস সালামদের ধারণ করেন?

কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক আবদুস সালাম ব্যক্তিগত চিন্তা না করে যেভাবে সত্য লিখেছেন জীবনভর, সত্যের প্রশ্নে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেভাবে অটল ছিলেন, বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিক ও সম্পাদকরা তা অনুসরণ করে সে পথে চললে বর্তমানে করুণ অবস্থায় থাকা এদেশের গণমাধ্যমজগতে সুদিন ফিরবে। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে যে সাংবাদিকতা আবদুস সালাম করে গেছেন, তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে আছে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালামকে কতটুকু জানি মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

৭ বছর পর মা-ছেলের সাক্ষাৎ
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর