কবি নবীনচন্দ্র সেনকে কতটুকু জানি
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:২৭
আজ ১০ ফেব্রুয়ারি কবি নবীনচন্দ্র সেনের ১৭৭তম জন্মদিন। ১৮৪৭ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ার প্রসিদ্ধ এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বয়স যখন পাঁচবছর তখন থেকেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। তিনি ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথমশ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৮৬৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফএ এবং ১৮৬৯ সালে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন থেকে বিএ পাশ করেন নবীনচন্দ্র সেন।
কবিতা দিয়েই নবীনচন্দ্র সেনের সাহিত্যিকজীবনে প্রবেশ ঘটে। এফএ শ্রেণীতে (বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক) পড়াকালীন সময়ে তার প্রথম কবিতা ‘কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি’ তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা এডুকেশন গেজেট-এ প্রকাশিত হয়। তার প্রথম কাব্যসংকলন অবকাশরঞ্জিনী প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে। ১৮৭৫ সালে তার পলাশীর যুদ্ধ মহাকাব্য প্রকাশিত হলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। রৈবতক (১৮৮৭), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩) ও প্রভাস (১৮৯৬) কাব্যত্রয়ী নবীনচন্দ্রের কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ বলে বিবেচিত। নবীনচন্দ্রের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- আমার জীবন, খৃস্ট, ক্লিওপেট্রা, ভানুমতী, প্রবাসের পত্র ইত্যাদি। তিনি ভগবদ্গীতা ও চণ্ডীর কাব্যানুবাদ করেন। তার আত্মজীবনী “আমার জীবন” গ্রন্থ উপন্যাসের মতো সুখপাঠ্য একটি গ্রন্থ যা পাঠককে মুগ্ধ করতে বাধ্য করবে। আত্মজীবনী যে এমন সুখপাঠ্য হতে পারে তা সাহিত্যে বিরল। তাছাড়া তার এ গ্রন্থটি সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনিকব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি প্রামাণ্য দলিল। তার লেখায় স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশানুরাগ ঘুরেফিরে এসেছে।
নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন একাধারে কবি, প্রশাসক ও সংগঠক। তাকে বলা হয়ে থাকে “আধুনিক ফেনী মহকুমার রুপকার”। ফেনীতে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে দুই দফায় প্রায় নয় বছর তিনি কর্মরত ছিলেন। যা ফেনীর জন্য ছিল সুবর্ণ সময়। ফেনী প্রসঙ্গে তিনি তার আত্মজীবনী “আমার জীবন” গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “বেহারে যখন তিন বৎসর শেষ হইয়া বদলি আসন্ন হইল, তখন স্বামী স্ত্রী দুজনেই ভাবিলাম যে বহু বরস বিদেশে উড়িষ্যা বাঙ্গালা বেহার ঘুরিয়া কাটাইলাম। যদি বাড়ির নিকটে ফেণী সাব-ডিভিসনটি পাইতে পারি বড় সুবিধা হয়। শ্রীভগবান সেই আশা আজ পূর্ণ করিলেন। মনে কত আনন্দই হইয়াছে। আমি পার্শনেল এসিসটেন্ট থাকিতে ১৮৭৫ সালে এ সাবডিভিসন খোলা হইয়াছিল। এই স্থানটি চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা হইতে বহুদূরে, অথচ তিন জেলার রাস্তার সঙ্গম স্থলে অবস্থিত। এখানে দিনে ডাকাতি হইত। আমার চেষ্টায় সাব-ডিভিসন খোলা হয়, এবং এই স্থানটি নির্বাচিত হয়। এ কারণে এ স্থানটির উপর আমার একটুক আন্তরিক স্নেহ ছিল।”
আর তার আন্তরিক স্নেহের কারণে এককালীন জঙ্গলাকীর্ণ ফেনীকে আজকের আধুনিক ফেনীরূপে দেখতে পারছি আমরা। ফেনীর আধুনিকায়ন নবীনচন্দ্র সেনের জন্ম সহজতর ছিল না। একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানকে আধুনিক ও উন্নত করতে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। একটি পরিপূর্ণ ও আধুনিক শহর গড়ে তুলতে তাকে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা হয়েছিল। এসব চ্যালেঞ্জ ও নানা সমস্যার কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন তার আত্মজীবনী “আমার জীবন” গ্রন্থে। এ গ্রন্থে নবীনচন্দ্র সেন শুধু ১১৭ পৃষ্ঠা লিখেছেন তৎকালীন ফেনীর নানা বিষয়, সমস্যা, সংকট ও তার কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। তার এ গ্রন্থটিতে ফেনীর ইতিহাসের একটি অকাট্য দলিলও বলা যায়।
বাংলা সাহিত্যের পাঁচজন মহাকাব্য রচয়িতার মধ্যে কবি নবীনচন্দ্র সেন একজন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রশাসক, সংগঠক এবং আধুনিক ফেনী মহকুমার রূপকার। আজকের ফেনী পাইলট স্কুল, ফেনী বাজার প্রতিষ্ঠা, রাজাঝির দীঘি সংস্কার—এ সবই তার হাতে সৃষ্টি। অথচ এগুলোতে এই মহান মানুষটির অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন নেই এবং এই মানুষটি সম্পর্কে ফেনীবাসী প্রায় অনেকেই জানেন না। তার নামে শুধু ফেনী সরকারি কলেজের সামনে রাজাঝির দীঘির পাড়ঘেষা একটি লাইব্রেরি রয়েছে। কিন্তু তিনি আরও বেশি মূল্যায়নের দাবিদার।
প্রশাসক হিসেবে নবীনচন্দ্র সেন বর্তমান প্রশাসকদের জন্য আদর্শ হতে পারেন। প্রশাসক হিসেবে তিনি যে দেশপ্রেম ধারণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা কি আমাদের বর্তমান প্রশাসকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়? বর্তমান প্রজন্ম নবীনচন্দ্র সেনকে কতটুকু জানে বা ধারণ করে—সে প্রশ্ন স্বভাবতই সামনে চলে আসে। তাই নবীনচন্দ্র সেনকে এবং তার চেতনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই