প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:৪০
একজন নেলসন মাদিবা ম্যান্ডেলা পৃথিবীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে তার অকুতোভয় সংগ্রাম জীবনের জন্য। আজ সেই ৯ ফেব্রুয়ারি যে দিনে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা আসন গ্রহণ করছিলেন। তবে কৃষ্ণাঙ্গ থেকে দেশের প্রধান হওয়ার পিছনের গল্প খুব সহজ ছিল না। বিশ্বের আর কোনো এমন কারারুদ্ধ রাজনৈতিক পোকা আছে কী না জানা নেই। যিনি দীর্ঘ ৯৫ বছরের জীবনের প্রায় ২৭ বছর সময় কারাগারের ভিতরে ছিলেন। সহৃ করতে হয়েছে সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যচারের স্টিমরোলার! সমুদ্রের ভাসমান রবেন দ্বীপে নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছর কারাগার জীবন অতিবাহিত করেন। নিজ জাতির জন্য কতটুকু যুদ্ধ করতে হয় তা নেলসন ম্যান্ডেলাকে না দেখলে বুঝা যাবে না। নির্যাতিত একটা জাতি ও দেশকে কিভাবে সভ্য জাতি ও দেশে রুপান্তর করতে হয় তা তার সম্পর্কে গবেষণা না করলে মানুষ আন্দাজ করতে পারবে না। আজ এই ঐতিহাসিক রাজনীতিবিদ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
এই কালো মানিকের জন্ম যখন পৃথিবী উত্তপ্ত ছিল ঠিক তার শেষে মুহূর্তে। ১৯১৪-১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বাজছিল পৃথিবীতে। দুনিয়ার সমস্ত দিকে রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে। মৃত্যুর গন্ধে পরিপূর্ণ ছিল এই সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ। ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শাসন করছিল পৃথিবী জুড়ে। মানচিত্র দখল করার প্রতিযোগিতা চলছিল বিশ্বে। মানুষের জীবন যেখানে অনিশ্চিত সেখানে ১৮ জুলাই ১৯১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার এমভোজায় জন্মগ্রহণ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি গাডলা হেনরি ও নোসেকেনি ফ্যানির ঘরে জন্ম নেন। কথিত রয়েছে তার মা ফ্যানি তার বাবার তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন। তিনি জন্মের পরে পরিচিত ছিলেন রোহিলালা নামে। পিতার মৃত্যুর পরে ডালিন্ডিয়েবো নামে উচ্চপদাধিকারী একজন তাকে দত্তক নেন। এই মনে যে পরবর্তী সেই জনপদে জনপ্রিয় নেতা হবেন ম্যান্ডেলা।
শিক্ষা জীবনে তিনি প্রাইমারি স্কুল শেষ করেন স্থানীয় এক কনভেন্ট থেকে। বলা হয়ে থাকে সেখানে পড়াশোনা চলাকালে তাকে “নেলসন” নামটা উপাধি দেন তার এক শিক্ষক। ১৯৩৯ সালে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। যেখানে তার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে পরিচয় হয়। যাঁর নাম ছিলেন অলিভার টেম্বো। যিনি পরবর্তীতে তার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন। যদিও তাদের দুজনকে বিশ্ববিদ্যালয় নীতি ভঙ্গের জন্য বহিষ্কার করেছিলেন। এক সময় তিনি বাড়ি থেকে জানতে পারেন বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে। মানে বিয়ে করতে হবে। তিনি বিয়েতে না বসে উল্টো বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ভিটভাটারস্র্যান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং জোহান্সেবার্গে আইন পেশার কাজ শুরু করেন। তিনি তার পরিবার থেকে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে প্রথম ছিলেন।
এই মহান মানবের উত্থান শুর হয় ১৯৪৩ সালে এএনসি তথা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগদানের মাধ্যমে। তিনি ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুব শাখার প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন শুরুর দিকে। ১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠায় বিশাল অবদান রাখেন। কালো লোকজনের উপর অত্যচার ও জুলুম শুরু হলে তিনি বসে থাকেন নাই। সে সময় আফ্রিকা বর্ণবাদের জন্য বিখ্যাত ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য শুরু হলে তিনি কঠোর আন্দোলনের ডাক দেন। সংগ্রামের জীবন পরিচালনা করার জন্য তিনি এএনসির সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েন। বর্ণবাদ দূরীকরণে সঙ্গী অলিভারকে নিয়ে ১৯৫২ সালে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ আইন পরিষদ ঘঠন করেন। যার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল বর্ণবাদী শিকার হওয়া মানুষদের সাহায্য করা, পাশে থাকা এবং কম খরচে আইনে লড়া। ১৯৫৫ সালে তীব্র আন্দোলন শুর করলে দলে দলে তার সাথে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ যোগাদান করেন। ফলে দেশজুড়ে মহা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলে তার বিরুদ্ধে তিনি সহ ১৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করেন শ্বেতাঙ্গ সরকার।
১৯৬০ সালে শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গ অবরোধ ও বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ নির্যাতন চালালে পুলিশের গুলিতে প্রায় ৬৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হন। তারপর থেকে বর্ণবাদ আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। আরো তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনে তার একটা কথা মনে পড়ল এক সভায় তিনি বলেন, ❝সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিষ্ফল।❞ ১৯৬১ সালে তিনি মুক্তি পান কারাগার থেকে। নেলসন ম্যান্ডেলা তিনি ১৯৬১ সালে ❝স্পিয়ার অফ দ্য নেশন❞ নামে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নয়া একটি সশস্ত্র অংশের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন।
সেসময় তিনি বেআইনিভাবে দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন। ইথিওপিয়ায় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতাদের একটা বিশাল সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। তাছাড়া আলজেরিয়ায় গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন এবং আরো বিভিন্ন রাজনৈতিক কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। দেশে ফেরার কিছুদিন পর পরেই ৫ই আগস্ট ১৯৬২ সালে অবৈধ দেশ ছাড়া ও ১৯৬১ এর শ্রমিক অসন্তোষ উস্কে দেওয়ার অভিযোগ এনে তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং তার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ষড়যন্ত্রেরর অভিযোগ এনে মামলায় রমরমা করে ফেলে। মামলা তার বিরুদ্ধে গেলে অল্পের জন্য ফাঁসি থেকে রেহাই পান। ম্যান্ডেলা ও তার সঙ্গীদের রিভোনিয়া ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে তিনি ২৭ বছর অন্ধকার জীবন কাটান কারারুদ্ধ বন্ধী হয়ে।
ফেব্রুয়ারি ১১, ১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্তি পান ম্যান্ডেলা। মূলত শ্বেতাঙ্গ নেতা এফ ডাব্লিউ ডি ক্লার্কের ভূমিকায় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন ম্যান্ডেলা। পরে নেলসন ম্যান্ডেলা ও ডি ক্লার্ক বর্ণবাদবিহীন আফ্রিকার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেন। আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সাথে আলোচনায় বসেন বর্ণবাদ নিষ্কাশনের জন্য, গৃহ যুদ্ধ কমানো এবং সর্বোপরি শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। বহু কষ্টে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ মিলে একমত হলে দেশে শান্তি বিরাজমন করে। বন্ধুসুলভ হয়ে কাজ করে দুই চির-দ্বন্দ্ব শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ জাতি। এই আলোচনার জেরেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিদায় নেয় বর্ণবাদী সব আইন-প্রথা ও কাজকর্ম। তাদের অনবদ্য অসামান্য অবদানের জন্য যৌথভাবে ডি ক্লার্ক এবং নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর অধিক সম্মান জনক নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে এই অভিজাত পূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেন তারা।
অবশেষে বর্ণবাদ সমাপ্ত হলে দেশে শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মানুষ খাঁটি সোনাকে অমূল্য করেনি। তারা তাদের শক্তিধর নেতাকে তাদের সরকার হিসেবে নির্বাচিত করছিলেন। অবশ্যই এই নির্বাচনে ম্যান্ডেলা তার দল এএনসি’র হয়ে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। সৃষ্টি হয় নয়া ইতিহাস আফ্রিকায়। পুরো বিশ্ব সমর্থন দিয়েছিল এই অবিসংবাদিত নেতাকে। নেলসন মাদিবা ম্যান্ডেলা ১০ মে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন সংবিধান আসে। কেন্দ্রীয় সরকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ছিল এই সংবিধানের মূল কথা। একই সাথে ছিল, দুর্বলের ওপর অত্যাচার করা যাবেনা, চামড়ার রঙ সাদা বা কালো যাই হোক না কেন।
এই মহান নেতা ২০০৪ সালে তার ৮৬তম জন্মদিনে সকল ধরনের রাজনৈতিক জীবন ও সরকারি জীবন থেকে অবসরে যান নিজ ইচ্ছায়। তিনি আজও মানুষের মনে এক ঐতিহাসিক মর্যদা পূর্ণ নেতা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। তার সম্মানে ২০০৯ সালে ১৮ জুলাই কে ❝নেলসন ম্যান্ডেলা ইন্টারন্যাশনাল ডে❞ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের মঞ্চে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি এবং মানবাধিকারে প্রচুর অবদান রাখা এই ব্যাক্তির নিঃশ্বাসও একদিন বন্ধ হয়েছিল। হারিয়ে গেছিল আফ্রিকা ও বিশ্বকে কাঁদিয়ে। এই মহা রাজনীতিবিদের অধ্যায় ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সমাপ্ত হয়। আফ্রিকা হারায় এক মহা নায়ককে। শেষ করছি তার একটি কথা দিয়ে, “আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন।”
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস