একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫২
“ওরা আসবে চুপি চুপি যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ। সবকটা জানালা খুলে দাও না আমি গাইব গাই বিজয়ের গান”- গুনগুন করে গানটি করছিল মুক্তিযোদ্ধা মান্নান মামা খুব সম্ভবত ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি অনুষ্ঠানে। শুনতে বেশ ভালো লাগছিল ৭১-র বীর সেনা মান্নান মামার কণ্ঠ। গৌরবোজ্জ্বল মহা স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে একসময় একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি ’৭১। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম অনেক শত্রু সেনাদের খতম করব। দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্ন ডানায় চড়ে, লাল সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে আনন্দ মিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!
আহারে, শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয় গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। যুদ্ধদিনের গল্প স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নক্ষত্র মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসে-খেলে ঘুরে বেড়াই, জোছনা ভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে। জাঁকিয়ে যখন শীত নামে কুয়াশার চাদর ছিড়ে প্রভাতফেরিতে যায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। আনন্দ-সুখ-দুঃখ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ। এত সুন্দর আমার দেশের মাটি বিশে^ আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ।
মা-মাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, খুব কাছের প্রতিবেশী পটিয়া পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের আবদুল মান্নান ( মুক্তিযোদ্ধা নম্বর-০১১৫০০০১২৯৬)। যাকে আমি মামা বলে সম্বোধন করি। তিনি ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মনির আহমদ মাত দেলোয়ারা খাতুন। এলাকায় তিনি ছাতি মান্নান নামে পরিচিত। ১৯৮৫ কি ৮৬ সালের দিকে পটিয়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছিলেন। প্রতীক ছিল ছাতা। সেই থেকে ছাতা মান্নান নামে পরিচিত। ছেলেবেলা থেকে বেশ দুরন্ত প্রকৃতির । পড়ালেখার হাতেখড়ি শশাংক মালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৯ সালে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ছেলেবেলায় বেশ ফুটবল খেলতেন। ছিলেন নামকরা গোলকিপার।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, ১৯৭১ সালের কথা তখন চট্টগ্রাম কারিগরি কলেজের ২য় বর্ষে অধ্যয়ন করছিলাম। সে সময় থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। কারিগরি কলেজের ছাত্রলীগের নির্বাহী পরিষদের সক্রিয় সদস্য। সে সময় ভিপি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল হারুন এবং জিএস ছিলেন, মিরসরাইয়ের তুষার কান্তি দাশ।
১৯৭১ সালের কথা, দেশে ঝামেলা বাধল, ৬মার্চ বন্ধুরা সবাই মিলে চায়ের দোকনের রেডিয়োতে ভাষণ শুনছিলাম। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ভাষণ শুনে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম দেশের জন্য কাঁধে অস্ত্র তুলে নিব। বীর মুক্তিযোদ্ধা মান্নান মামা যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের সেই ভাষণ এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন শীর্ষ নেতা এম আর সিদ্দীকি, এম এ হান্নান,, জহুর আহমদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবু ছালেহ, আইয়ুব বাঙ্গালী, ছাবের আহমেদ,, মিয়া ফারুকী, শহিদ মৌলবি সৈয়দসহ আরো অনেকে। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ২৫ মার্চ পাক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নির্বিচারে পিশাচের মতো হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন। বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ বেঁচে থাকা মানুষের আহাজারি। ২৬ ও ২৭ মার্চের দিকে আমরা ষোলশহর ২নং গেট এলাকা অবরোধ করে পাকিস্তানিদের চলাচলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সে সময় সোয়াত জাহাজ থেকে পাক বাহিনী বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ করতে থাকলে কর্নেল শওকত, ক্যাপ্টেন হারুন, সামরিকবাহিনীর ও ইপিআর বাহিনী সহ কালুরঘাট ব্রিজ দিয়ে আপেলের টেক ও বোয়ালখালী পেত শাহ দরগাহ গেটে ছুটে আসি। সোখানে অবস্থান নিয়ে কিছুসময় অতিবাহিত করি। এতে পাকবাহিনীর সদস্যরা অতর্কিতভাবে গুলি চালাতে থাকে সেসময় ক্যাপ্টেন হারুন গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে পটিয়া নিয়ে আসি।
পরবর্তীতে আমরা দলবদ্ধ হয়ে প্রফেসর শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে আমরা প্রায় ২২ জনের মুক্তিবাহিনীর একটা গ্রুপ করে রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি হয়ে ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্যে বগাফা বিএসএফ ক্যাম্পে গমন করি। সেখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ১০ কি ১১ দিনের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর কিছু অস্ত্র গ্রেনেড সাথে নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হয়ে বোয়ালখালী প্রবেশ করি এবং একসময় আমরা বোয়ালখালী এসে রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীর অধিবাসী পাক বিমানবাহিনীর কর্পোরাল শহিদ ক্যাপ্টেন করিমের সহযোগিতায় ধলঘাট, গৈড়লা গ্রামের প্রয়াত মু্িক্তযুদ্ধের সংগঠক বামপন্থী নেতা আহমেদ হোসেনের বাড়িতে অবস্থান করি। সে সময় আমাদের সাথে ছিলেন অনিল লালা, রফিক আহমদ । আমরা ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে রাউজান কাপ্তাই রাজস্থলী, পটিয়া, বোয়ালখালী এবং চন্দাইশের কিছু অংশে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। পাকিন্তানিরা যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য রাস্তাঘাটে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, ব্রিজ কালভার্ট উড়িয়ে দেই। ১৯৭১ সালে ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানিরা পটিয়ায় ইন্দ্রপুল, থানারমোড় গোবিন্দারখীল, হাইদগাঁও কেলিশহর এলাকায় বোমা হামলা করলে প্রায় ২০ জন শহিদ হন। ১৩ ডিসেম্বর পটিয়া হানাদার মুক্ত হন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৩ ডিসেম্বর পটিয়ায় বীর মু্িক্তযোদ্ধা অধ্যাপক আবু সৈয়দ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহসিন খান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। যুদ্ধকালীন সময়ে পুরাতন কাপ্তাইয়ের রাজস্থলী বাজারে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড-র মাঝের ঘাটার প্রিয় বন্ধু রফিক আহাম্মদ ওরফে রউফ। তাঁর মৃত্যুর খবরটি আমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। তাঁর কবরটি কাপ্তাইয়ে রাজস্থলী থেকে। সবচেয়ে বড়ো বিষাদের স্মৃতি মায়ের মৃত্যু।
যুদ্ধের পরবর্তী ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছিলাম, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এই বাংলাদেশের জন্ম হতো না। যাঁর ডাকে সেদিন সবাই একত্রিত হয়েছিল দেশ স্বাধীন করতে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান পেশায় ছিলেন একজন ঠিকাদার। ১৯৮৭ সনের দিকে পটিয়া পল্লী বিদ্যুৎ ঠিকাদারি করেন। ১৯৮৪ সালের দিকে চট্টগ্রাম লোহাগাড়া থানার দক্ষিণ শুকছড়ি দরবার শরিফের আওলাদ সৈয়দা দিলরুবার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধা মান্নান মামার ৩ পুত্র ও ৩ কন্যার জনক। কর্মজীবন শেষ করে বর্তমানে মানবসেবাই নিয়োজিত। নিজের অর্জিত সঞ্চয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতার সম্পূর্ণ টাকায় ব্যয় করেন মানবসেবায়। নিজের বাসভবনে প্রতিষ্ঠা গড়েছেন, মুক্তির আলো ফাউন্ডেশন, এতিমখানা ও তাঁর প্রয়াত বাবা ও মায়ের নামে মনির-দেলোয়ারা বৃদ্ধাশ্রম। নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে পারলেই তাঁর আনন্দ। সত্যি আমরা সোনার বাংলাদেশে বাস করি ঠিকই কিন্তু সোনার মানুষ পাওয়া বড়ো মুশকিল। ৭১-র দামাল মান্নান মামারা শুধু দেশ স্বাধীন করেননি। প্রতিনিয়ত করে আসছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মানবিক মান্নান মামারা সোনার মানুষ।।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম আপনার জীবনের চাওয়াপাওয়া কী? তিনি বললেন, কিছুই চাওয়াপাওয়ার নেই। বঙ্গবন্ধুর তনয়া মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটা চাওয়াপাওয়া এই স্বাধীন দেশে যেন সুষ্ঠু গণতন্ত্রটা বেঁচে থাকে অনন্তকাল। নিজেকে এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। বড়ো দুঃসময় চলে এসেছে। ভুয়া এবং নীতি নৈতিকতা বিহীন অনেক হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে আছে। সত্যিকারের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অপমানিত হতে হয় লাঞ্ছিত হতে হয় । একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা প্রত্যাশা করি না এটার জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম? একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেউ অসম্মান করবেন না। তিনি তরুণ প্রজন্মদের উদ্দেশে বলেন, মাদক, ইয়াবা ও কিশোর গ্যাং মুক্ত সুন্দর একটি আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণদেরকে তিনি পড়ালেখা করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন। তরুণ সমাজ এগিয়ে গেলে আগামীর বাংলাদেশ তাদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন দেশ, মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসুন। জয় বাংলা !
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই