Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইলিশের দাম কেন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে?

অমিত বণিক
২৫ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৫১

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। কিন্তু অনেক বছর ধরে গরিব মানুষের রান্নাঘরে ইলিশের সুবাস ছড়ায় না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে। ভরা মৌসুমে বাজারে জোগান ভালো থাকলেও ইলিশ কখনোই গরিব বা স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না। সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে—অর্থনীতির এই সহজ সূত্র ইলিশের বাজারে গিয়ে ব্যর্থ মনে হয়।

শোনা যায়, আড়তদাররা ইলিশের দাম সবসময়ই উঁচুতে তুলে রাখেন। ট্রলার ভরে মোকামে মাছ এলেও তারা সবসময় সংকট সৃষ্টি করে থাকেন। ক্রেতাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে চাহিদার তুলনায় মাছ কম। তবে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইলিশ মাছ আহরণের খরচ অনেক বেশি এবং খরচ অনেক বেড়েছে। আগে ইলিশ মাছ ধরার জন্য একটা ট্রলার পাঠাতে খরচ হতো ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা, কিন্তু এখন সেখানে খরচ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। কখনও আরও বেশি। ফলে একটি ট্রলার মালিক একটির বেশি ট্রলার পাঠাতে পারেন না। আবার তিনি যে টাকা খরচ করে ট্রলার পাঠান, সেই ট্রলারের জেলেরা যদি পর্যাপ্ত ইলিশ না পান, তাহলে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়। ফলে কোনও ট্রলার মালিক যদি অনেক ইলিশ পেয়েও যান, তিনি আগের লোকসান পুষিয়ে নিতে চান। সেই সঙ্গে তিনি লাভও করতে চান। না হলে এই পেশায় তার টিকে থাকা সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেদের তরফে বিভিন্ন সময়ে এই অভিযোগ শোনা গেছে যে, মা ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশে যখন ৬৫ দিনের অবরোধ চলে, যখন জেলেরা ইলিশ ধরতে যেতে পারে না, ওই সময়ে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় জেলেরা। অথচ ওই নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশের ডিম ছাড়ার সময়। এই সমস্যার মূল কারণ বাংলাদেশের সীমানায় যখন ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ, একই সময়ে ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে না। ইলিশ যেহেতু দ্রুত গতিসম্পন্ন মাছ এবং সমুদ্রের ভেতরে সে যেহেতু সীমানা চেনে না; তার বিচরণের ক্ষেত্রে যেহেতু পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন হয় না, ফলে সে ওই নিষিদ্ধ মৌসুমেও ভারতের সীমানায় চলে যায় এবং ভারতীয় জেলেদের জালে আটকা পড়ে। অনেক সময় ভারতীয় ট্রলারও বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পড়ার অপরাধে ভারতীয় ট্রলার আটকের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সত্তরের দশকে ইলিশকে জাতীয় মাছ ঘোষনা হলেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। স্বাদে, ঘ্রাণে, রূপে অন্যান্য মাছকে পেছনে ফেলে ইলিশ বাঙালি সমাজে ‘মাছের রাজা’ হিসেবে সমাদৃত। শুধু যে রূপে গুণে বিষয়টা এমন ও না, অন্যান্য মাছের পুষ্টিগুণের দিক থেকেও এগিয়ে আছে এই সমুদ্র থেকে আসা নদীর রাজা। এই মাছটিতে আছে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। পুষ্টিবিদদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে প্রোটিন থাকে ২১.৮ গ্রাম, ভিটামিন সি থাকে ২৪ মিলিগ্রাম, শর্করা আছে ৩.৩৯ গ্রাম, খনিজ রয়েছে ২.২ গ্রাম ও চর্বি ১৯.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ও বিভিন্ন খনিজ রয়েছে ১৮০ মিলিগ্রাম, তাছাড়াও রয়েছে খনিজ লবণ, আয়োডিন এবং লিপড। যা অন্যান্য মাছ ও মাংসের তুলনায় অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে, ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরের স্থান এই ইলিশের। জনপ্রিয়তায় শীর্ষে স্যামন ও টুনা মাছের পরই এই আমাদের ইলিশের অবস্থান। চিকিৎসকদের মতে, ইলিশ মাছ হার্ট সুস্থ রাখে, রক্ত সঞ্চালন ও বাত নিয়ন্ত্রণের সহায়ক, রাতকানা রোধে, ক্যান্সার মোকাবেলায়, হাঁপানি রোধে, অবসাদ দূর করতে, ত্বকের যত্নে, শিশুদের মস্তিষ্কের গঠনে সহায়ক। গবেষকদের মতে, ইলিশে আছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন। তাছাড়াও আছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা রক্তের কোলেস্টেরল ও ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ফলে হার্ট সুস্থ থাকে। তাই হৃদরোগীদের জন্য ইলিশের তেল উপকারী। ইলিশ মাছে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। এই মাছের স্বাদ, ঘ্রাণ আর উপরোক্ত গুণের কারণেই মাছের রাজার মর্যাদা পেয়েছে এই ইলিশ মাছ। কিন্তু বহুগুণ থাকা এই মাছটি এখন ক্রয় ক্ষমতার বাহিরেও চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।

জানা গেছে, এক সময়ে চাঁদপুরের ইলিশ দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি হওয়া এই ব্যান্ডিং জেলাকে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর বলা হলেও সেখানকার সেই ঐতিহ্য আর এখন নেই। কারন ঐ জেলার সাধারণ ক্রেতা ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী চাঁদপুরের ইলিশের উৎপাদন কম থাকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ দিয়ে চাহিদা পূরণ হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের মাছ দিয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন সকাল থেকেই মাছঘাটে ব্যস্ত সময় পার করছেন ইলিশ ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ ঘাটে ৩০০-৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা, ৫০০ গ্রামের উপর থেকে ৮০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি প্রায় ১৬০০ টাকা, ১২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ১৮০০ টাকা ও দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশের কেজি প্রায় ২ হাজার টাকার উপরে পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে তিন কেজি ওজনের এক ইলিশ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়ারও খবর রয়েছে এই আড়তে। এত দামে পাইকারি বিক্রি হলে খুচরা বিক্রি হবে তো আরো অনেক দামে।

এদিকে দেশের বাজারে এত ইলিশ মাছ। তবুও দামে আগুন। দেড় হাজার টাকা কেজি চায় খুচরা বিক্রেতারা। সাধারণ মানুষ কি এই দামে ইলিশ কেনা সম্ভব? এই সময় ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের নাগালের বাহিরে। তবে কি ইলিশ মাছ বড় লোকের খাবার? গরিবের কপালে এখন আর নেই এই জাতীয় মাছটি। এখন ইলিশ কেনা মানেই বিলাসিতা করা। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেয়া আগামী প্রজন্ম চিনতেই পারবে না বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। তারা বইয়ের পাতায় পড়লেও বাস্তবে দেখতে পাবে না কাঙ্খিত এ মাছটিকে। কারণ, এসব পরিবারের অভিভাবকরা এত চড়া দামে ইলিশ কিনে সন্তানদের খাওয়ানো আসলেই অসম্ভব। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উচ্চ দামের সাথে স্বল্প আয়ের এসব মানুষগুলো ইলিশের স্বাদ পাওয়া স্বপ্ন দেখতে হবে। তবে একসময়ের সাধারণ মানুষের মাছ এখন ধনীদের প্রিয় খাবার। কিন্তু ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার এই মাছ রক্ষায় অনেক অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ে মা মাছ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করেছে। আর মৎস্যশিকারিদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করছে। যে কারণে দেশে ইলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই মাছ এখনো দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আসেনি। কারণ, এই মাছ ধরা থেকে শুরু করে পুরো বিপণনব্যবস্থা একটি সামন্তচক্রের হাতে যেন বন্দী! এ কারণে ইলিশের দাম কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে জাতীয় এই মাছ সবার ক্রয়সীমার মধ্যে আসবে। এই জাতীয় মাছটির মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক ।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এজেডএস

অমিত বণিক ইলিশের দাম

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর