নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের চরম দুর্ভোগ
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৪
কিছুদিন পর পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তার নাভিশ্বাস চরমে উঠে। দেশে কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে চাল, ডাল, পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই গত কয়েক সপ্তাহে বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম গত দুই সপ্তাহে দ্বিগুণ বেড়েছে। এছাড়া মসুর ডাল, আদা, চিনি, ভোজ্য তেল—সব কিছুরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি সবজি, মুরগি এবং মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে। এদিকে বাসাবাড়িতে তীব্র গ্যাস সংকট মূহুর্তেও বেড়েছে গ্যাসের দাম। আবার পানির দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব করেছে ওয়াসা।
আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বৃদ্ধি, রপ্তানিকারক দেশের জটিলতা আর দেশের মিল থেকে সরবরাহ বন্ধ এ ধরনের নানা অজুহাতে চরমভাবে অস্থিতিশীল দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, তেল এবং চিনি সবকিছুরই দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। আমাদের বাজার ব্যবস্থায় এখনো এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা কাজ করে। অর্থনীতির সাধারণ সূত্রগুলোও এখানে অচল। সুযোগ পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এই আরোপিত মূল্যের বৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ জনগণ।
এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ধেয়ে আসছে মূল্যস্ফীতি। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হারে ঊর্ধ্বগতি, শ্রমবাজারে কর্মের অভাব, সর্বোপরি করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আগামীতে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্লেখ্য, দেশের হালনাগাদ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে চারটি প্রধান ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো—বৈশ্বিক খাতে প্রত্যাশার চেয়ে পুনরুদ্ধারের গতি কম; বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হারে ঊর্ধ্বগতি; শ্রমবাজারে কর্মের অভাব এবং পণ্য পরিবহণ খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্যপণ্যসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তবে সম্প্রতি খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক।
দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। তাই যে কোনো পণ্যের দামের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক দেশের পরিস্থিতির পাশাপাশি বুকিং রেটের ওপর ভরসা করতে হয় এ দেশের ভোক্তাদের। বাংলাদেশের বাজারে মূলত ভারত-মিয়ানমার ও চীন থেকে পেঁয়াজ-আদা-রসুন, এবং ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানি করা হয়। এই সবকটি পণ্যের দামই এখন বাড়তি। পেঁয়াজের দাম গত দুই সপ্তাহে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাজারে কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। অথচ এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে, আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ছয় লাখ টন। বন্ধ নেই আমদানিও। তারপরও এভাবে দাম বাড়ার কারণ কী?
বিগত কয়েক মাস ধরেই ভোজ্য তেলের বাজারে ঊর্ধ্বগতি বিরাজমান। সম্প্রতি তা আবার বেড়েছে। আর এক্ষেত্রে প্রধান অজুহাত আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়া। এ বছর ধান উৎপাদনেও রেকর্ড হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২৪ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বাজারে এসবের কোনো প্রভাব নেই। বরং উল্টো চিত্রটাই দেখা যায়। সম্প্রতি আবার বেড়েছে চালের দাম।
বাজারে এখন শীতকালীন সবজির যথেষ্ট সরবারহ রয়েছে। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে বরং বেড়েছে। মুরগি, ডিমের দামও বেড়েছে বহুলাংশে।এমন বাজার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রীতিমতো নাভিশ্বাস চরমে উঠে গেছে। পারতপক্ষে, বারবার হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির মূলে রয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক পণ্য মূল্য প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার কারণে গত বছর দেশে সব ধরনের চালের দাম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে গড়ে ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ বেড়েছে স্বর্ণা পারিজাসহ মোটা চালের দাম। মিনিকেট ও নাজিরশাইলসহ সরু চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক খুচরা বাজারে পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুইদিনের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ, পাম অয়েল লিটারে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ ও পাম অয়েল সুপারের লিটারে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। তিন দিনের ব্যবধানে কেজিতে চিনির মূল্য ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, দুই দিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
আমাদের বাজার ব্যবস্থায় যেমন নিয়ম-নীতি খাটে না, তেমনি নৈতিকতার ঘাটতিও প্রবল। সভ্য সমাজে বিশেষ উপলক্ষ বা উৎসবের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমতে দেখা যায় অথবা স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু পবিত্র রমজান বা অন্য কোনো উপলক্ষের আগে আগে আমাদের বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। দাম বাড়ানোর জন্য অজুহাতেরও কোনো অভাব হয় না। বৃষ্টি-বাদল থেকে শুরু করে হরতাল-অবরোধ পর্যন্ত অনেক কিছুই হতে পারে দাম বাড়ানোর অজুহাত। এমনকি নির্বাচনকেও অনেক সময় অজুহাত করা হয়। আসন্ন রমজানের তিন মাস আগ থেকেই শুরু হয়েছে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারসাজি। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাত তো অনেক পুরনো। বাজারের এমন অস্বাভাবিকতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা দায়ী। বাজারে তদারকির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি অভাব রয়েছে সরকারের হস্তক্ষেপেরও। টিসিবির ওপেন মার্কেট সেলসহ (ওএমএস) কিছু উদ্যোগ থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো একেবারেই নগণ্য।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। মজুত, সিন্ডিকেট বা কোনো অনৈতিক উপায়ে কেউ যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন সংশোধন করে এসবের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দাবিকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকারকে সর্বোচ্চ যৌক্তিক অবস্থান নিতে হবে। দাম বাড়ানোর কারণগুলো যথাযথভাবে ভোক্তাদের অবহিত করতে হবে। আমাদের দেশে বাজারব্যবস্থার সর্বত্রই একধরনের সিন্ডিকেটের প্রভাব লক্ষণীয়। এ সিন্ডিকেট চক্র কিছুদিন পর পর হুট করেই বাজারব্যবস্থা অস্থিতিশীল করে তোলে। এসব সিন্ডিকেট চক্রের লাগাম টেনে ধরতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ও আর্থিক কাঠামোর করুণ পরিণতির ব্যাপারে ইতঃপূর্বে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, করোনার অভিঘাতে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা যে কোনো আর্থিক মন্দার চেয়ে খারাপ হবে। করোনার প্রকোপে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে, একইভাবে দেশের অর্থনীতিও নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে।
লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিপর্যয় নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন ও ভারত থেকে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এ দুই দেশেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ভারতে গত তিন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ শতাংশে উঠেছে। ভারত থেকে পণ্য আমদানির ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বর্তমান সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখতে হবে। এর ফলে অদূরভবিষ্যতে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে—এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। বস্তুত এর মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করতে হবে। আশার কথা, এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এ ধারাবাহিকতায় সরকারও বিভিন্ন নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে সংশিষ্ট খাতগুলোকে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখবে, এটাই প্রত্যাশা।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সর্বাগ্রে মানুষের মধ্যে আস্থা সঞ্চার করা জরুরি। দেশবাসীকে এ নিশ্চয়তা প্রদান করা উচিত যে, কোনোভাইে তাদের আয় হ্রাস পাবে না। এর ফলে মানুষ খরচ করবে ও অর্থনীতিতে ভোগ বাড়বে। এতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গতি পাবে, যা এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে একইসঙ্গে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আসার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে করোনাকালীন জাতীয় দুর্যোগ মুহূর্তে বারবার হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি ভোক্তা জনসাধারণের জন্য যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। কেন কিছুদিন পর পর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি ঘটে, এর নেপথ্যে কী—তা উদঘাটন করে সার্বিক বাজারব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম- মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের চরম দুর্ভোগ মুক্তমত