অস্বস্থির আরেক নাম বায়ু দূষণ
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:৫০
বায়ু দূষণ কতটা মারাত্বক সেটা আমাদের অজানা নয়। কারণ আমরা বায়ু দূষণের সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকি এইদেশে। বাংলাদেশ বায়ু দূষণের তালিকায় শীর্ষস্থান অথবা দ্বিতীয়তম অবস্থানে থাকেই। আর শহর হিসেবে ঢাকাও একই আচরণ করে। কখনও দিল্লির সাথে পাল্লা কখনও পেশওয়ারের সাথে। মোটামোটি প্রথম-দ্বিতীয় অবস্থানে থাকেই। এই যেমন এবারও ঢাকা তার শীর্ষ স্থান দখল করে আছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। যেখানে সবার প্রথমেই ঢাকার অবস্থান। তালিকায় এপরই আছে যথাক্রমে কলকাতা এবং নয়াদিল্লি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়ালের’ বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। এ তালিকোয় প্রথম অবস্থানে লাহোরে, তৃতীয় অবস্থানে আছে নয়াদিল্লি। সুতরাং ঢাকার এই নাম থাকবেই। যেহেতু ঢাকা একটি রাজধানী তাই এটতে এমন চাপ থাকতেই পারে। কিন্তু এটি যখন দিনের পর দিন বেড়ে চলে এবং অন্যান্য শহরগুলোতেও ছড়িয়ে যায় তখন এটা ভয়ংকর বিষয় হয়ে যায়।
অথচ এই দূষণ যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের উপায় আমরা কোনো ভাবেই পাচ্ছি না। প্রতিবারই এই এক বিষয় নিয়ে আলোচনা, গোলটেবিল, টকশো হয়। গবেষকরা আলোচনা করেন। এপরই এই বিষয়টা হারিয়ে যায়। আমরা আবার শুধু একটা শহর নিয়ে পড়ে না থেকে পুরো দেশের কথাটাও ভাবতে হবে। কারণ পুরো বাংলাদেশও বায়ু দূষণে উপরের তালিকায় থাকে। তাই প্রতিটা শহর নিয়ে ভাবতে হবে। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই শহরেও বায়ু দূষণ এখন অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। প্রতিদিন এ শহরে পন্যবাহী গাড়ি ঢুকছে বের হচ্ছে। বিভিন্ন মালামাল এ শহরে আসছে যাচ্ছে। এসব গাড়ি থেকে যে পরিমাণ কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে তা সরাসরি আমাদেরই নাকে প্রবেশ করছে। এ শহরে বায়ুু দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে যানজট। যানজটের মাধ্যমে শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার মাধমেও বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এ শহরের রাস্তায় রয়েছে প্রচুর ধুলা-বালি। যা বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে চলে যাচ্ছে নিয়মিত। এছাড়াও সড়কের গাড়িগুলোতে এখনও রয়েছে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া। এই কালো ধোঁয়া আমাদের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে নিয়মিত প্রবেশ করছে।
বায়ুু দূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠান্ডা করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ুু দূষণ আরো বাড়ছে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি বায়ুদূষণ দায়ী। বায়ুদূষণের ফলে যে শুধুমাত্র আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি তা কিন্তু নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ু দূষণের ফলে ওজনস্তর পাতলা হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুস ক্যান্সার এবং ফুসফুসের রোগে বছরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। বায়ু দূষণের ফলে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অন্তত ১.২৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বায়ুর গুণগতমান বিষয়ক তথ্য নিয়ে এ গবেষণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণযুক্ত পরিবেশে কোনো শিশু বেড়ে উঠলে তার গড় আয়ু ৩০ মাস (২.৫ বছর) পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। মৃত্যুঝুঁকির অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ অধিকতর দায়ী। বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুুকণা)। এশিয়ায় বায়ুর গুণমান অনেক খারাপ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২.৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে।
পরিবেশ বিষয়ক এক সেমিনারে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত ওই সেমিনারে বায়ু দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ু দূষণের ফলে শুধু এশিয়াতেই প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন ২৬ লাখ মানুষ। এবং এই কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পর সবচেয়ে বায়ু দূষণে দূষিত দেশ বাংলাদেশ। এ গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুতে পিএম ২.৫ উপাদানের কারণে বিশ্বে তিন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
এছাড়াও সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পল্যুশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে মানুষের তৎক্ষণাৎ বা দ্রুত মৃত্যু হয় না। বরং এটা এক ধরণের নীরব ঘাতক। মানুষের মৃত্যুর দশটি কারণের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে এই বায়ু দূষণ। গত ৩০ বছরে পানি এবং পয়:নিষ্কাশনজনিত মৃত্যুহার কমলেও বায়ু দূষণ জনিত মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বায়ু দূষণের কারণে দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।
তাই বায়ু দূষণ থেকে দেশকে এবং দেশের মানুষকে বাচাঁতে হলে অবশ্যই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। ঢাকাকেন্দ্রিক ভাবনা বাদ দিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জেলার পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। ঢাকার পরে বায়ু দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে চট্টগ্রামে। তাই এটাকে সহজ বিষয় হিসেবে না নিয়ে এ দূষণের বিরোদ্ধে কঠোর হতে হবে। এছাড়া পরিবেশবাদী সকল সংগঠনের প্রতি অনুরোধ লোক দেখানো কাজ বাদ দিয়ে আপনার এলাকার পরিবেশ সার্বক্ষণিক সুন্দর এবং স্বচ্ছ রাখুন আগে। একদিনের সৌন্দর্য় দিয়ে কিছুই হয় না। মানুষকে বায়ু দূষণ নিয়ে সচেতন এবং কঠোর হতে পরামর্শ দিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশ দূষণের মারাত্মক প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য শুধু আমরা সচেতন হলেই হবে না। সরকারকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এবং কঠোর হাতে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। যাতে বায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। তাই এ বিষয়ে প্রশাসন এবং সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকা আবশ্যক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস