পুঁজিবাদের বিস্তার, বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য
১২ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৪৪ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৫:০২
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রাণ প্রকৃতির উপর শাসন কিংবা শোষণ চলছে অতি মাত্রায়। এতে করে যত দিন যাচ্ছে ততই যেন পৃথিবীতে মানবজাতির বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের দাপট বেড়ে চলছে। নিত্য নতুন ভাবে বেড়েই চলছে প্রলেতারিয়েতদের সংখ্যা মানুষের জীবনের কষ্টের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। ফলে এ সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনীতিক বৈষম্য প্রকট আকার দেখা দিয়েছে।
যার মূলমন্ত্রের নাম হলো পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এ সমাজ ব্যবস্থায় এক শ্রেণির মানুষ অন্যের শ্রম ঠকিয়ে অর্থনীতির পাহাড় গড়ে তুলে। শ্রমজীবী মানুষ শ্রমের ন্যায্য মূল না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের আগ্রাসনের বাইরে নেই বাংলাদেশেও। সবুজ শ্যামল সোনালী দেশের বাঙালি ও অবাঙালি মানুষের জীবন কেমন চলছে? রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণের শৃঙ্খলের কেউ কি বন্ধি থাকতে চায়? পুঁজিবাদের গ্রাসে নিন্ম আয়ের মানুষ পানিহীন পুকুরের মাছের মত অবস্থা তৈরী হয়েছে।
ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই সোনার বাংলা। এ বাংলার মাঠে ফসলে হাসলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। আর কৃষকরে মুখের হাসিতে বাংলাদেশে হাসে। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের কি বলে দেয়? কৃষকদের মুখের হাসি স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে কোনো শাসক কি কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে?
আসন্ন আমন ঘরে তুলবে কৃষক। আমরা কখনো কি চিন্তা করে দেখেছি এই আমন মৌসুমে কৃষকেরা সারের জন্য কিরকম ভোগান্তির শিকার হয়েছিল তা আমাদের সবার জানা। কালোবাজারি ডিলারদের কাছে সার না পেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে সার ক্রয় করে কৃষক তার মাঠে আমন ধান চাষ করেছিল।
এর মধ্যে আবার থমকে থমকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছরের চেয়ে উৎপাদন খচর বেড়ে গিয়েছে।উৎপাদন খরচ বেড়েছে কিন্তু কৃষি ফসলের বিক্রয়মূল্য কি আদৌও বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ। তবে কথা হলো এবারের আমনে কৃষকের দুর্দশা কি শেষ হবে? উত্তর টা অজানা নয়। প্রতিবছর সার, বীজ ও কীটনাশকসহ উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণ সিন্ডিকেটের হাতে কৃষকরা জিম্মি থাকে।
ফলে কৃষক তার ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়ায় কৃষকের যে হাহাকারের বাস্তব গল্প তা রাষ্ট্রযন্ত্র কখনও শুনতে চায় না। কৃষকরা এক শ্রেণির গোষ্ঠির কাছে কাঠামোগত সহিংসতায় শিকার তাও আমরা কেউ প্রকাশ করতে চাই না। ফলে কৃষকদের দুর্দশা দূর করা কোনো শাসকের পদক্ষেপ নেই এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
এ ভাবে বছরের পর বছর কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে সর্বহারা হয়ে যায়।
এমনকি ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঋণগ্রস্ত করে তুলছে। তখন বলতে কষ্ট হয় পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান ও সবুজের সমারোহ মাঠ ভরা ফসলের দেশ বাংলাদেশ। উদ্বিগ্নতার সাথে বলতে হয় এদেশের সাধারণ মানুষ ভালো নেই। শ্রায়ের আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে ওএমএসের চাল, আটা কিনতে আসা নিন্ম আয়ের মানুষের ভোগান্তির গল্পটা যেন বাস্তব চিত্র বুঝা যায়। এই ভোগান্তির শেষ কোথায়? রাষ্ট্রের শিক্ষা কবে হবে? কৃষি বাঁচলে কৃষক বাঁচবে আর কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
তবে রাষ্ট্রের শিক্ষা মৌলিক অধিকার তা কি কখনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতিতে চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার সংকটের মধ্যে বড় সংকট হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে পাইচ্ছি বাস্তবে এটি কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাম রাখার যোগ্যতা আছে?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কোনো রকম ক্লাসের ব্যবস্থা, কোনো গবেষণার ব্যবস্থা নেই, ক্যাপাসে কোনো শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। এখানে রাজনৈতিক চর্চা তো দূরের কথা এখানে চলে অপরাজনীতির চর্চার কেন্দ্র।
শিক্ষায় জাতি কতটা পিছিয়ে গেলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে কোন পথে শিক্ষাব্যবস্থা যাচ্ছে? বাস্তবে তো বিজ্ঞানী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলতে এখনও হয়নি। যেখানে শিক্ষাকে আমরা বানিয়েছে বাজারের পণ্যের মত। তাহলে সেই পণ্যমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে আমরা কতটুকু এগিয়ে যেতে পারি।
সময় এসেছে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার সংকট দূর করতে হলে গবেষণা বা বিজ্ঞানাগারের পরিধি বাড়াতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। এ জন্য বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখতে হবে। দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তবে খেয়াল করতে হবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষদের বদলে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ জ্ঞানচর্চার উপযোগী করতে হবে। এজন্য অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, বিদেশি বিজ্ঞান জার্নাল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাস্তার পথশিশু হিসেবে আমরা যাদের চিনি তাদের পথশিশু কে বানায়? রাষ্ট্রেই তো পথশিশু বানায়। এজন্য রাষ্ট্রে উচিত তাদের দায়িত্ব নেওয়া। তাদের বিনা বেতনে শিক্ষা ও শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি আওতায় আনতে হবে। সেই সাথে যথযথ ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাহাড় থেকে সমতলে শিশু ও নারীদের কান্নার শব্দে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠছে। কথায় আছে সর্ব অঙ্গে ব্যথা, মলম দিবো কোথা? ঠিক তেমনি যেন রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে ব্যথা শুরু হয়েছে। মলম দিবে কে? রাষ্ট্রের সারা দেহের ব্যথা নিয়ে চলতে চলতে দেশের মানুষ ঘুম থেকে সকালে উঠে উদ্বিগ্নতা নিয়ে আবার বুক ভরা হতাশা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায় । কথাটি বলছি আমার দেশের কোটি কোটি বেকার যুবকদের কথা। তাদের হতাশা দূর করার জন্য কাজের ব্যবস্থা কি হবে? তবে অনেকেই কাজ না পেয়ে ভাগ্যের নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে। তখন কুলকিনারা না পেয়ে ওই শেষ ভরসা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইতিহাসের সকল রেকর্ড যে ভঙ্গ করেছে তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে। বাজার অর্থনীতি অব্যহত রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেই ক্রয় ক্ষমতাও তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানুষের ভাতের অধিকার টুকু যদি কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে কি আর কোনো অস্তিত্ব থাকে? দুর্নীতিবাজ, আমলা, লুটেরা রাজনীতিবিদ, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দেশ ভরে গেছে। বিশেষ করে দুর্নীতি, লুটপাট, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম, টাকা পাচার বন্ধ করা না হয় তাহলে দেশ মহা সংকটের দিকে যাবে।
ফলে এতে মানুষের কষ্ট বাড়বে, দুর্ভোগ বাড়বে। তখন দুর্ভোগের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণ মানুষের অধিকার। টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ডিজেল ও কেরোসিন তেলে দাম বৃদ্ধি নয় ডিজেলে ব্যবহারকারীদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভর্তুকি দিতে হবে। গ্রামীণ রেশনিং ব্যাবস্থা চালু করতে হবে। দেশে ঘনঘন জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। ক্ষতি হবে অর্থনীতির। নারী প্রতি সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রের সমস্যা রাষ্ট্রকেই সমাধান করতে হবে। রাজনীতি নামে হানাহানি মারামারি নয় রাজনীতি মানে জনগণের নীতি, রাজনীতি মানে কোনো ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলা নয় যে রাজনীতির মাঠে রাজনীতিবিদরা মাঠে খেলবে। রাজনীতি হোক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার, রাজনীতি মানুষের কল্যাণের তাই মহা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ হোক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পুঁজিবাদের বিস্তার- বেড়েছে অর্থনৈতীক বৈষম্য মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ