Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মৃতির আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
১১ অক্টোবর ২০২২ ১৪:৩৭

বিপ্লবী-সংগ্রামী শহীদ মুজিবর রহমান। দেশ বরেণ্য এই রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, জনতৈষী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সমাজচিন্তক, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলনের আলোকবর্তিকা, দেশমাতৃকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আজ স্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন অনেকটা। একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, ভাষা সৈনিক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে আমরা কি ভুলে যাব? নাকি স্মরণ করে লাভ নেই বলেই সবাই ভুলে গেছে। হতে পারে, আজ আর তাকে কোনো প্রয়োজন নেই। তাই বলে তো তার সংগ্রামী জীবনের কথা ভুলে যেতে পারি না।

বিজ্ঞাপন

তিনি সেই রাজনীতি করতেন, যে রাজনীতিতে কোনো ভাগাভাগির হিসাব ছিল না। যে রাজনীতিতে ছিল না কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল। তিনি এমন রাজনীতি করেছেন, যে রাজনীতি সমাজে অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির কথা ছিল। ইতিহাসের এক দুর্মর ঘূর্ণাবর্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মানুষ নাম তার মুজিবর রহমান। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক কর্মী। জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠের ধ্বনিতে স্বাধীনতার স্পর্ধিত উচ্চারণে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমেছিল মুক্তির সংগ্রামে। নেতৃত্ব দিয়েছেন গ্রামের মুক্তিসেনাদের।

বিজ্ঞাপন

শহীদ মুজিবর রহমান ১৯১১ সালে ১ জানুয়ারি বর্তমান জয়পুরহাট জেলা আক্কেলপুর পৌরসভার আমুট্ট গ্রামের এক সম্ভান্ত মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মিশরত উল্ল্যা মন্ডল, মাতা মরহুম কফিরন বেওয়া। শহীদ মুজিবর রহমান শিক্ষাজীবন শুরু হয় আক্কেলপুর তথা জয়পুরহাট জেলার প্রাচীনতম বিদ্যালয় সোনামুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯২৯ সালে এই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন তিনি ‘ব্রিটিশ হটাও’ আন্দোলনে বৃহত্তর বগুড়া জেলার পশ্চিম বগুড়া থেকে ছাত্রদের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজটিকিট দিয়ে স্কুল থেকে বিতাড়িত করেছিল। তিনি যেন আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে না পারেন। ফলে তার পড়াশোনা আর বেশিদূর এগোয়নি।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোনের সুবাদে তার সাথে পরিচয় ঘটে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বগুড়া মেহাম্মদ আলী এবং মাওলানা ভাসানী প্রমূখ উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদদের। তিনি ছিলেন তাদের রাজনৈতিক সহচর। ভাষা আন্দোলনে তিনি এই এলাকায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিল তার সু-গভীর সম্পর্ক। তবে সঙ্গতকারণে বঙ্গবন্ধুর নামের সাথে তার নামের এবং উভয়ের স্ত্রীর নাম ফজিলাতুন্নেছা হওয়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে তার পারিবারিক আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর তাই বঙ্গবন্ধু তাকে আক্কেলপুরী সাহেব” নামে ডাকতেন। সেই থেকে তার হয়ে যায় মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত ৬-দফা আন্দোলনে তিনি বৃহত্তর বগুড়া জেলায় তার নির্বাচনী এলাকায় অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এসময় তার নেতৃত্বে বৃহত্তর বগুড়া জেলার সর্বস্তরের মানুষ আইয়ূব-ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৬-দফার পথ ধরে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এই এলাকায় তার কর্মতৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন।

এই আন্দোলনে শহীদ মুজিবর রহমান মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে কাজ করেন। আর সেই সুবাদে মাওলানা ভাসানী মুজিবর রহমানের আক্কেলপুরের বাড়িতে আসেন। তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোন বক্তব্য দিতেন তখন শ্রোতারা তার বক্তব্য মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতেন। তাই তিনি হয়ে ওঠেন এই এলাকার মানুষের প্রিয় চেনামূখ। আর এই বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পথ বেয়ে তিনি ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন পান (তৎকালীন বগুড়া-২, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি থানা) এবং এই এলাকার এম.এন.এ নির্বাচিত হন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি ছিলেন ঈর্ষনীয় একজন জনপ্রতিনিধি।

তার নিজ এলাকা বর্তমান আক্কেলপুর উপজেলার ১ নং রুকিন্দীপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি একটানা ৩৬ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যা এখন প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। কতটা জনপ্রিয় হলে একজন মানুষ একটানা এই দায়িত্ব পালন করতে পারে তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। তিনি ছিলেন এলাকার মানুষের সবসময়ের সুখ-দুঃখের সাথী। তাই এই ইউনিয়নবাসী আজও তাকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই জননন্দিত নেতাকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কা প্রতীকে বৃহত্তর বগুড়া-২ (কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুর্গচাঁচিয়া ও আদমদীঘি থানা) আসনে মনোনয়ন দেন এবং সবাইকে তাক লাগিয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সহ যে তিনজন প্রার্থী সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হন শহীদ মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী ছিলেন তাদের একজন।

যিনি জীবিতাবস্থায় বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখালেখি করতেন এবং তার লেখা প্রকাশিত হত প্রায় সব পত্রিকায়, সেই খ্যাতিমান সাহিত্যিক আব্দুস সাত্তার মৃধা কর্তৃক রচিত “জয়পুরহাটের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এই বিখ্যাত জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। সদ্যপ্রয়াত এই শক্তিশালী সাহিত্যিক বইখানি শহীদ মুজিবর রহমানের একমাত্র কন্যা সন্তান মাহফুজা সুলতানা (মলি)-কে উৎসর্গ করেছেন। ফলে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ইতিহাস হয়ে গেছেন। এই এলাকার আকাশে বাতাসে আরো শত শত বছর তার নাম ধ্বনিত হবে।

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের রচয়িতা শহীদ মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান রচিয়তাদের মধ্যে একজন। বাংলাদেশের প্রথম হস্ত লিখিত সংবিধানের ঐতিহাসিক দলিলে তার স্বাক্ষর রয়েছে। যতদিন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে থাকবে ততদিন তার এই স্বাক্ষর তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিবে। তাই তিনি ইতিহাস হয়ে রইলেন বাংলাদেশের সংবিধানে যা নিঃসন্দেহে গৌরবের। শিক্ষানুরাগী হিসেবে শহীদ মুজিবর রহমান যদিও তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারেননি কিন্তু তার প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে তার নির্বাচনী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার নিজ জন্মভূমি এলাকায় তার নিজের জমির উপর আক্কেলপুরে প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আক্কেলপুরবাসী তাকে ভালোবেসে তার নামে নামকরণ করে কলেজটির নাম দেন “আক্কেলপুর মুজিবর রহমান কলেজ”।

এছাড়াও আক্কেলপুর এফ, ইউ, পাইলট হাইস্কুল, আক্কেলপুর গার্লস হাইস্কুল, আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসা তার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি “বগুড়া আজিজুল হক কলেজ”-এর একজন দাতা সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন পরম বিদ্যানুরাগী। এলাকার অনেক কৃষক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের তিনি পড়াশুনায় উৎসাহিত করতেন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। যার দরুন এলাকায় একটি শিক্ষিত সভ্যসমাজ গড়ে ওঠে। তবে দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র বদলে যারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিল তারাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক দুই বছর পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৭ই অক্টোবর আক্কেলপুর অদূরে গোপীনাথপুর থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যেবেলায় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নির্মম বুলেটের আঘাতে এই মহান নেতা নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ঘাতকেরা চায়নি তিনি বেঁচে থাকুক আর স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন। বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি: নেতার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু সংগঠন বেঁচে থাকলে আদর্শের মৃত্যু নেই। তাই তিনি নশ্বর হয়েও অবিনশ্বর, মৃত্যুর পরও তিনি মৃত্যুহীন।

এই দেশের জয়পুরহাটের গ্রামীণ জনপদে, এই মাতৃভাষা তারই ললাটে অমরত্বের বিজয়টিকা এঁকে দিয়েছেন, দেশমাতৃকা তার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকেই অমরত্বের বর দান করেছেন। তার নাম গাঁথা হয়ে আছে আমাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধার সোপানে। তার দ্রোহ, বিপ্লব আর সংগ্রামের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর শৌর্যকে অন্তরে লালন করার জন্য স্মৃতির আড়ালে এই থাকা মহান ব্যক্তির জীবন সংগ্রাম ও কীর্তিত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা জরুরি।

আগামী প্রজন্মের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন। তিনি সাহিত্যে ও রাজনীতে অতুলনীয় এক ব্যক্তি। তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির বাণীবাহক কারণ গ্রামের মানুষের মধ্যে কূপমন্ডুকতা অজ্ঞনতা, অমূলক ও অবিবেচনাপ্রসুত তকমাসমূহ দূর করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন আজীবন। আমাদের অনুপ্রেরণা ও চেতনার প্রতীক মহাপুরুষদের মধ্যে মুজিবর রহমান হলেন একজন। গোটা বাঙালি জাতির আদর্শের নাম যেমন প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধা। ঠিক তেমনি মুজিবর রহমান বাঙালি জাতির ইতিহাসের নতুন পরিচয়ের নাম।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ স্মৃতির আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী