নারী নির্যাতন ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শেষ কোথায়
২৪ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪১ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪৯
সময়ের পরিবর্তনে সাথে সমাজে অনেক কিছুই পরিবর্তন হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে নিয়ে ভোগপণ্য মানষিকতার কোনো পরিবর্তন নেই। ফলে নারী পুরুষের সমতুল্য হতে পারে না এমন চিন্তায় যেন স্থির। তবে একটু গভীরে গিয়ে যদি বলা হয় নারী দেখতে তেঁতুলের মত, নারী দেখতে কমলার মত ও নারী দেখতে আপেলের মত ইত্যাদি এ রকম হাজারও উদাহরণ দিয়ে নারীকে ভোগবিলাসী বস্তু হিসাবে পণ্যের চোখে দেখে পুরুষশাসিত সভ্য নামের সমাজ।
প্রতিনিয়ত ফেসবুক ও ইউটিউব সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের মাধ্যমে নারীদের তুচ্ছ মনে করা হচ্ছে। নারী পুরুষের তুলনায় অতি নগণ্য এই ধারণা সমাজের প্রত্যেক পুরুষের মাথায় গিজগিজ করে বুঝানো হয়। এমনকি নতুন প্রজন্মের কন্যা শিশুদের এমন ধারণা দিয়ে বড় করে গড়ে তোলা হয়। তখন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে আমরা যে সমাজে বাস করি তা সভ্য সমাজ না কি অসভ্য সমাজ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
একদল প্রতিবাদী মানুষ খুঁজতে থাকে সভ্য সমাজের অসভ্য মানুষদের। যারা কিনা দেহের বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষ হলেও তাদের কাজকর্ম অমানুষদের মত অর্থাৎ পশুদের চেয়ে নিকৃষ্ট। আর সেই সব নিকৃষ্ট হিংস্র প্রানীদের হাত থেকে বাঁচতে পারে না আমাদের সমাজের ঘরে-বাইরে, পাহাড় কিংবা সমতলের শিশু কন্যা থেকে যুবতী এমন কি বৃদ্ধা। অসভ্য মানুষের ভিরে সমাজে নারী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। ওই সব অসভ্যদের বিচারের দাবিতে প্রতিবাদী মানুষ যখন রাজপথে আন্দোলন করে আর সেই আন্দোলনকারীদের উপর হামলা মামলা হয়। এ কেন সমাজের নীতি? প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমের সংবাদের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন রকমের প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হচ্ছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন নিপীড়নের মত ঘটনা বেড়েই চলছে। এর সমাধানের পথ কি?
একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে পুলিশি হেফাজতে ১৪ বছরের গার্মেন্টস কর্মী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যাকে কেন্দ্র করে এক গণআন্দোলন হয়। আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্য ও ড্রাইভারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেই থেকে ইয়াসমিন হত্যার এই দিনটিকে আমাদের দেশের প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ইয়াসমিন হত্যার ২৭ বছর পরও নারী নির্যাতনের চিত্র আজও একইরকম। রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন উদ্বিগতা বেড়ে যায়। পুলিশ জনগনের নিরাপত্তা দিবে কিন্তু সেই পুলিশের কাছে সাধারন মানুষ আতঙ্কে থাকে তখন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা তৈরী হয়।
সংবাদপত্রের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ৪ জন, ২০১৯ সালে ৩ জন, ২০২০ সালে ৪ জন এবং ২০২১ সালে বছরের এখন পর্যন্ত ৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায় দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যা শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী পর্যন্ত। এ জন্য দায়ী কে ছোট্ট শিশুটি? বৃদ্ধ মহিলা? যুবতী নারী? কিশোরী না কি তরুণী? এর জন্য দায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরাই কারণ ছোট্ট এক কন্যা শিশু সে পোশাকে পড়তে জানে না। অথচ সেও ধর্ষণের শিকার হয়।
ধর্ষণকারীদের মৃত্যদন্ড আইন হলেও বাস্তবে বিচারের ফলাফল দেখলে বুঝা যায় যে ধর্ষণকারীদের বিচার সংখ্যা ঝুড়ির তলানির নিচে। আজও তনু হত্যার বিচার করতে পারেনি রাষ্ট্র। নির্যাতিত নারী প্রতি সমাজ-রাষ্ট্র তো নয়ই, নিজ পরিবারও নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ায় না। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হলে তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হয় না। এ সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নারী ও পুরুষ লিঙ্গ ভেদে বৈষম্য আমাদের সমাজে নানা স্তরে বিস্তার করার কারণে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীদের নানামুখী অন্যায়-অত্যাচার এবং সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা হয়। পূর্বে নারীর আচার-আচরণ কেমন ছিলো তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। ছেলে সন্তান আট-দশটা রিলেশন করলে তার সতীত্বে কোনো কলঙ্কের দাগ পড়ে না, কিন্তু মেয়ে সন্তান দু-তিনটা রিলেশন করলে তার কলঙ্কের দাগ লাগে। তাকে চরিত্রহীন বলে সমাজের পঁচা দূর্গন্ধ পণ্যের সাথে তুলনা করা হয়। বিবাহের সময় ছেলে সন্তান কালো হলে সমস্যা নাই, কিন্তু মেয়ে সন্তান কালো হলেই নানামুখী সমস্যা। বিয়েতে যৌতুকের টাকা বেশি দিতে হবে।
আমাদের গ্রামাঞ্চল বা শহরের পরিবারে ছেলে সন্তান জন্ম নিলে পরিবার গর্ববোধ করে মিষ্টি বিতরণ করে। আর মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পরিবারে কালো মেঘ নেমে আসে চোখেমুখে চিন্তার কারনে কপালে ভাজ চলে আসে। পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে ছেলে সন্তানকে মালিক হিসাবে অলিখিত ভাবে গণ্য করা হয়। শিশুকাল থেকে ছেলে এবং মেয়ে সন্তানকে একই পদ্ধতিতে গড়ে তোলা হয় না। ছেলে সন্তানকে যে ভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয়, কন্যা সন্তানকে সে ভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। কন্যা সন্তানকে বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণ সময় কাটাবে আর ছেলে সন্তান বাবার সাথে বাইরের কাজে সময় দিবে। খাবার খাওয়ানোর সময় আমিষ জাতীয় খাবার ছেলে সন্তানকে বেশি দেওয়া হয়। ছেলে সন্তানের প্রতি এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করার মধ্য দিয়ে ছেলে সন্তানেরা মানসিক ভাবে এককেন্দ্রিক চিন্তায় বড় হয়ে উঠে। পরিবার থেকেই ছেলে শিশুটি নিজে ভাবতে থাকে যে কন্যা শিশুর চেয়ে তার সমাজের মধ্যে প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। অটোমেটিক ভাবে সমাজে নারীদের ছোট করে দেখা বা পুরুষের সমপর্যায়ের ভাবার মনোবৃত্তি তার মধ্যে জন্মায় না। এই শিক্ষাটা চলতে থাকে বংশপরম্পরায় এবং তা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে পরিবার থেকে সমাজের সর্বস্তরে।
নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ নারীর দূর্বলতা। পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনবৈষম্যের কারণে নারীর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব অন্যতম একটি কারণ। পারিবারিক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার না থাকায় একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত হন এবং এর পাশাপাশি সচেতন এবং অবচেতনভাবেই তিনি পুরুষের চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন বা দুর্বলতাকে বোঝানো হয়। যার ফলে পুরুষরা নিজেদের বেশি শক্তিশালী, ক্ষমতাবান এবং বেশি যোগ্য বলে ভাবতে শুরু করেন। পরিবার এবং সমাজব্যবস্থায় নারী-পুরুষ ভেদে ভিন্নরকমের ও বৈষম্যমূলক আচরণ নারীর প্রতি অসম্মান এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য রাষ্ট্রকে যে বিষয় টা গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে আমাদের সংবিধানের ২৮ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’। অর্থাৎ সংবিধানে গণজীবন বা সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হলেও সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়নি। সম্প্রতি সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করা একান্ত প্রয়োজন।
নারীর প্রতি অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং দৃশ্য-অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা দূর করতে হলে পারিবারিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডে নারীর সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যেন কোনো ভাবে হয়রানিমূলক আচার-আচরণ করা না হয় তার জন্য সামাজিক ও শিক্ষাব্যবস্থায় অবকাঠামোতে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দিতে দিতে হবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যদি নারীদের সত্যিকার অর্থে সম্মান করতে শেখার অভ্যাসটা গড়ে তুলতে পারেন, তবে সেটি তার পরবর্তী প্রজন্মসহ সামগ্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে। নারীকে পণ্য কিংবা দুর্বল ‘মেয়ে মানুষ’ নয় বরং মানুষ হিসেবে ভাবার সংস্কৃতিটা আমাদের পরিবার থেকেই নিশ্চিত করতে হবে।
কুরুচিপূর্ণ বেহায়াপনা অপসংস্কৃতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ করতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিবর্তন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংতার ঘটনায় হাত কিংবা পা ধরে গ্রাম্য শালিসির মাধ্যমে যেন সমাধানের পথ না নেওয়া হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে সম অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে মানুষ ভাবার শিক্ষা এবং নারীর অধিকার সর্বপ্রথম পারিবারিক পরিমণ্ডলেই নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি নির্যাতন সহিংসতা বন্ধের জন্য পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হলে নাটক, সিনেমা, পথসভার মাধ্যমে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
নারী নির্যাতন ও পুরুষতান্ত্রিক মানষিকতার শেষ কোথায় মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ