গরিবের দুর্দশা দূর করার দায়িত্ব কার?
১৮ আগস্ট ২০২২ ১৭:৩৩
নিত্য নতুন ভাবে বেড়ে চলছে প্রলেতারিয়েতদের সংখ্যা। সমাজে মানুষের মধ্যে বিচরণ করলে দেখা যাবে মানুষের জীবন ও সংসার কষ্টের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ উৎপাদন করে আরেক শ্রেণির মানুষ উৎপাদন না করেও ঘরে বসে থেকে সুবিধা লাভ করে। যার কারণে তৈরী হয় অর্থনীতিক বৈষম্য। যার মূলমন্ত্রের নাম হলো পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এ সমাজ ব্যবস্থায় এক শ্রেণির মানুষ অন্যের শ্রম লুট করে অর্থনীতির পাহাড় গড়ে তুলে। আর অন্য দিকে খাবার না পেয়ে মানুষ ভবঘুরে থাকে। ফলে বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদ গ্রাস করে নিয়েছে।
তবে বিশেষ করে বাংলাদেশ নিয়ে মোদের গর্ব হয়। নিজের দেশের পরিচয় দিতে গৌরবে বুক ভরে আসে। কারণ পাকিস্তানের শোষণের শৃঙ্খলের বেড়াজাল ভেঙে চূড়মার করে দিয়েছিল বাংলার দামাল সন্তানেরা। একটি অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত স্বাধীন দেশ নিয়ে আমরা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। তাই তো আমাদের দেশের মানুষ মনের গহিন থেকে কিছু গান মনে মনে গুনগুন করে, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা। ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। সে যে আমার জন্মভূমি সে যে আমার জন্মভূমি।’
আজ আমার জন্মভূমি কেমন আছে? কেমন আছে আমার জন্মভূমির সন্তান – সন্তানাদি। আমরা কি শোষণের শৃঙ্খলের আবদ্ধ? না কি পুঁজিবাদের গ্রাসে মোদের জন্মভূমির মানুষ পানিহীন পুকুরের মাছের জীবনের মত অবস্থা তৈরী হয়েছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে ধন ধান্য পুষ্প ভরা মোদের কৃষি ফসলের দেশে কৃষক বন্ধুরা কেমন আছে? জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে মোদের দেশের কলে- কারখানার শ্রমিক বন্ধুরা? জানতে ইচ্ছে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেমন আছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা? জানতে ইচ্ছে করে দিন এনে দিন খাওয়া দিনমজুর বন্ধুরা কেমন আছে? রাস্তার পথশিশু হিসেবে আমরা যাদের চিনি তারা কেমন আছে? পাহাড় থেকে সমতলে আমাদের নারী শিশু কন্যারা কেমন আছে? ট্রেন যাতাযাতে যাত্রীরা কেমন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে মোদের দেশের প্রাণ প্রকৃতি কেমন আছে? বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম কি মানুষের হাতের নাগালে আছে? রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশ এক গণতান্ত্রিক দেশ। সেই গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রে অবস্থা কোন পথে? দেশ পথে যাচ্ছে সে পথ তো অন্ধকারে আছন্ন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলে আমজনতা পিষ্ট হচ্ছে না তো, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের কতটুকু নজর আছে। গণতান্ত্রিক দেশে দাবি তুলতে গেলে মাথায় গুলি খেয়ে কবরে যেতে হয় কেন? জনপ্রতিনিধি বাছাই করে নেওয়া হয় জনগণের। ফলে জনগণ তাদের পরীক্ষিত মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি বাছাই করবে কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই মতামত যেন আর প্রয়োজন হয় না। অদৃশ্য শক্তি যেন জনগণের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। ক্ষমতাহীন জনগণের অবস্থা আজ বড় নাজেহাল। কাঠামোগত ভাবে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এসে ভর করে বসেছে। সে যেন এক নাছর বান্দা। কোনো ভাবেই ক্ষমতার মসনত ছাড়তে রাজি নয়।
কথায় আছে সর্ব অঙ্গে ব্যথা, মলম দিবো কোথা? ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে ব্যথা শুরু হয়েছে। মলম দিবে কে? রাষ্ট্রের সারা দেহের ব্যথা নিয়ে চলতে চলতে দেশের মানুষ ঘুম থেকে সকালে উঠে উদ্বিগ্নতা নিয়ে আবার বুক ভরা হতাশা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। কথাটি বলছি আমার দেশের কোটি কোটি বেকার যুবকদের কথা। তাদের কাজের ব্যবস্থা কি হবে? তারা কপালের উপর ছেড়ে দিয়েছে। মানুষ যখন কোনো কুলকিনারা পায় না। তখন শেষ ভরসা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ সবাই থাকে আতঙ্কে কারণ কারো জীবন কাটে অর্থের সংকটে আবার কারো জীবন কাটের হতাশা আর চিন্তায়। বাজারের দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলছে। এর মধ্যে আছে সড়কে মানুষের জীবন ও সম্পদ জিম্মি। এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি নেই?
মোদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জীবনের সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। সবুজ শ্যামল সোনার বাংলাদেশকে বলা হয় কৃষি ভিত্তিক দেশ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের উপর নির্ভর করে দেশ চলে। সেই কৃষকের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে যখন ঘোষণা করা হয় উরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। এর ফলে কৃষককে প্রতি কেজি সার ১৬ টাকার পরিবর্তে কিনতে হবে ২২ টাকায়। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধি প্রায় ৩৮ শতাংশ। আর একজন ডিলার পর্যায়ের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের কৃষক কাঠামো গত ভাবে শোষণের শিকার হবে। ধান উৎপাদনের ব্যয়ভার বেড়ে যাবে কিন্তু কৃষক যখন বাজারে ধান বিক্রি করতে যাবে তখন কি ধানের ন্যায্য পাবে?
কৃষকের দুদর্শার কথা শেষ হতে না হতেই সারা দেশে হঠাৎ শোরগোল উঠে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই এখন সাইকেল কিনতে চায়! এর কারণ কি হঠাৎ সবাই এমন কথা বলছে কেন? কারণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। রাত ১২টার পর থেকেই নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে। সরকার দাবি করছে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব গণমাধ্যম কিংবা আমাদের দেশের গণমাধ্যমের তথ্য মতে, বিশ্ব বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৯০ ডলার। তাহলে হিসাব করে দেখা যাক আমার জানি ১ ব্যারেল সমান ১৫৯ লিটার। আবার অপর দিকে আমরা জানি ১ ডলার সমান ১১০ টাকা। ১ ব্যারেল তেলের দাম বের করতে ১১০ টাকার সাথে ৯০ দ্বারা গুন দিলে পাওয়া যাবে ৯৯০০ টাকা। এখন যদি ১ লিটার তেলের দাম বের করতে যাই তাহলে প্রক্রিয়ায় দেখাতে হবে।
৯৯০০ টাকাকে ১৫৯ লিটার দ্বার ভাগ করলে ভাগ ফল ৬২.৬৪ টাকা। যা আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম। তবে পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক খরব মিলিয়ে লিটার প্রতি ১০ টাকা লাভ ধরলেও দ্বারায় ৭২.৬৪ টাকা। সেই জায়গায় আমাদের দেশে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৪ টাকা, ১৩০ টাকা ও ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। গণশুনারি না করে হঠাৎ কার স্বার্থে তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো? অথচ গত ২৭ জুলাই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে পরিষ্কার ভাবে বলছেন যে অকটেন ও পেট্রল আমাদেরকে বিশ্ব বাজার থেকে কিনতে হয় না। প্রাকৃতিক গ্যাসের বাই প্রডাক্ট হিসেবে এটা পাওয়া যায় এবং আমাদের চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ অকটেন, পেট্রলের মজুদ আছে। তাহলে এর দাম বাড়াল কেন?
আর সংখ্যান বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশে বছরে ৫৫ লাখ টনের মতো ডিজেল লাগে এবং এর পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ ডিজেলের ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত, ১৮ শতাংশ কৃষি, প্রায় ৮ শতাংশ শিল্প এবং বাকিটা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গৃহস্থালি খাতে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে বাসভাড়া সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম লাগামহীন ভাবে বাড়তে থাকবে। সরকার দুর্নীতি- লুটপাট বন্ধের পদক্ষেপ না নিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে একের পর এক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি করছে। ফলে মানুষের জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
দুর্নীতিবাজ- লুটপাটকারী দ্বারায় দেশ ভরিয়ে গেছে। গত সাত-আট বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকলেও তখন দেশে জ্বালানির মূল্য হ্রাস করতে আমরা দেখিনি। কিন্তু সরকারি তথ্য মতেও হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই লাভের টাকা কোথায় গেল? তেলের দামের এই ঊর্ধ্বমুখী তৎপরতার সময় সরকার চাইলে লাভের ওই টাকা থেকে সমন্বয় করতে পারত কারণ এর জন্য হাতে তহবিল ছিল। আর এ কাজ বেশি করতে হত না কারণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাচ্ছে। তবে আমাদের দেশেরে জন্য আরও দুঃখের সংবাদ আইএমএফের ঋণের শর্তের কারণে তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে বুঝা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক হওয়ার পথে। যার কারণে সরকার এমন কঠোর শর্তেও রাজি হয়েছে। অপর দিকে সরকারের যেহেতু বহু জায়গায়, বহু প্রকল্পে বহু ধরনের লিকেজ আছে, প্রচুর দুর্নীতি ও অতি ব্যয় আছে, ফলে সরকার এখন আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারে আর্থিক সংকটের জন্য দায়ি কে? কোনো কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুর মানুষ তো দায়ি নয় কারণ তারা দুর্নীতির সাথে জড়িত নয়। ফলে আর্থিক সংকটের চাপ জনগণের দেওয়া মোটেও কাম্য নয়। দিচ্ছে। এতে করে জনগণের জীবন তো দুর্বিষহ হবেই, অর্থনীতিতেও মন্দার ভাবে চাপ বাড়বে।
কেরোসিন তেলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় গ্রামাঞ্চলে। দাম বাড়ার ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি খরচ দিয়ে ফসল উৎপাদনের পর কৃষক পণ্যের দাম না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দাম বাড়ার ফলে হুহু করে সকল পণ্যের বাড়তে শুরু করছে । গ্রামীণ জীবনে ব্যয় বাড়বে। মানুষের কষ্ট বাড়বে, দুর্ভোগ বাড়বে। তখন দুর্ভোগের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণ মানুষের অধিকার। টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ডিজেল ও কেরোসিন তেলে দাম বৃদ্ধি নয় ডিজেলে ব্যবহারকারীদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভর্তুকি দিতে হবে। গ্রামীণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের সম্পদ যারা পাচার করে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গরিবের দুর্দশা দূর করার দায়িত্ব কার? মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ