চবিতে ছাত্রী হেনস্থা: বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় ও প্রাসঙ্গিক কথা
২৩ জুলাই ২০২২ ১৪:৫৩
আজকের ছাত্রসমাজ আগামীর দেশ গড়ার কারিগর। বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি দেশের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। একটি দেশের উন্নতি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়— মুক্তচিন্তা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পীঠস্থান।
একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পেছনে তার স্বপ্ন, একটি পরিবারের স্বপ্ন এবং একটি দেশ ও জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা জড়িত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সমাজ একটু ভিন্ন চোখে দেখে। তাদের ওপর সবার ইতিবাচক আশা—তারাই আগামীর সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। কিন্তু পরম দুঃখ ও হতাশার বিষয় হলো যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী নিজের ক্যাম্পাসেই নিজে নিরাপদ থাকতে পারেন না, নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন না।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক ছাত্রী তার ক্যাম্পাসের ভেতরেই জঘন্য যৌন হয়রানির শিকার হন। গত রোববার রাতে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গে চলতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে ৫ তরুণ সংঘবদ্ধ হয়ে ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করে এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। যা ২০২২ সালে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা জায়গায় ন্যাক্কারজনক ঘটনা। যদিও এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগের গৌরব আর ঐতিহ্যে নেই।
গত ১৭ জুলাই এ ঘটনা ঘটলেও এটি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে ২০ জুলাই রাতে। ঘটনার একদিন পর মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ জানানোর পর মূলত ঘটনা জানাজানি হয়। লিখিত অভিযোগ দায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মেয়েদের হলে রাত ১০ টার মধ্যে হলে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে ছাত্রীরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত না করে উল্টো ছাত্রীদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রতিবাদে এবং এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে শতাধিক ছাত্রী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। রাতে আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে চবি। এছাড়া ঘটনার চারদিন অতিবাহিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দোষীদের ধরতে না পারা শিক্ষার্থীদের আরও বেশি ক্ষোভে ফেটে ওঠে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান। পরে তিনি লিখিতভাবে চার কার্যদিবসের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত, আর তা না করতে পারলে পদত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি উত্থাপন করেন।
শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবি হলো:
১. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হল থেকে বের হওয়া, প্রবেশ এবং মেডিক্যালে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া যাবে না।
২. নতুন কার্যকরী যৌন নিপীড়ন সেল গঠন করতে হবে। সেলে বিচার কার্যকর করতে সর্বোচ্চ সময়সীমা বাঁধা থাকবে এক মাস এবং সেটি না হলে সেল স্বয়ং শাস্তির বিধান গঠনতন্ত্রে থাকবে।
৩. ৪ কার্যদিবসের মধ্যে যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান সব কেইসের বিচার করতে হবে।
৪. ৪ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।
দাবিগুলো সহসাই মেনে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ৪ কার্যদিবসের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক এবং আমরাও চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হোক। কিন্তু উল্লেখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দাবিগুলোতে আরও কঠোর হতে পারতো। দাবি উত্থাপনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরও কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারা যে দাবিটি সবশেষে নিয়ে গিয়েছে তথা চার নম্বর দাবিটি হওয়া উচিত ছিল প্রথম ও প্রধানতম দাবি। এবং যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত অপরাধীদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করে তাদের বিস্তারিত বৃত্তান্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা। কারণ একটা ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা গেলে ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণ।
চবি ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নতুন নয়। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের ভেতরেই দুই ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন। যথাযথ অভিযোগ দিয়েও বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা। আর প্রায়ই শাটল ট্রেনে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বহিরাগতদের দ্বারাও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এসবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেল থাকলেও সেটির কার্যক্রম অনেকটা স্থবিরই বলা চলে। ২০১৮ সালে গঠিত এই সেলের আহবায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। এই সেলে এখন পর্যন্ত যৌন নিপীড়নের চারটি অভিযোগ জমা হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি কমিটি। এমনকি একটি অভিযোগ চার বছর ধরে ঝুলে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী উপাচার্য যিনি নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক, ছাত্রীদের অনুপ্রেরণা—তার দায়িত্বকালে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বছরের পর বছর ঝুলে থাকা এবং বিচার না হওয়া মোটেও কাম্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঘটনা ও পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিক নিয়ে এখন রীতিমতো সমালোচনা হয়, প্রশ্ন তোলা হয়। সেটা প্রাসঙ্গিকও বটে। যদিও সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই অবস্থা। চবির প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা চবি প্রশাসনকে “অথর্ব” বলে থাকেন। যদিও প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। প্রশাসনিক কাঠামোতে যারা আছেন তাদেরও অনেকক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। কারণ শিক্ষায় এখন রাজনীতিকরণ চলমান। এর ফলে দিনদিন নষ্ট হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। যা সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু তারা রাজনীতিকরণের মোহে সে ক্ষমতার প্রকৃত চর্চা করতে পারছে না। এ কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করুণ দশা।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ দিনদিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অপরাজনীতি, অপশাসনে ভারাক্রান্ত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হলো শিক্ষার্থী। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা বড়ো বড়ো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এসে এখানে অনিয়ম, অনিরাপত্তা, অপশাসন, অব্যবস্থাপনার বেড়াজালে আটকা পড়েন। এসব বেড়াজালে অনেককেই শেষমেশ জীবন বলি দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। অথচ এখানে নেই গবেষণা, নেই গবেষণার গুরুত্ব। এখানে মুক্তচিন্তার চর্চা নেই, মুক্তমতের স্বাধীনতা নেই, নেই সাংস্কৃতিক চর্চা। দাসত্ব, তেলবাজী, চাটুকারিতা, মেরুদন্ডহীনতায় ভর দিয়ে চলছে এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। নিরাপত্তা, আবাসন সংকট, সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতা, চিকিৎসা সেবা—এসব মৌলিক সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। আমরা চাই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বমহিমায় ফিরে আসুক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক। ছাত্রী যৌন হয়রানির ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমরা চবিতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হোক যাতে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না করে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক—এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইমরান ইমন চবিতে ছাত্রী হেনস্থা: বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় ও প্রাসঙ্গিক কথা মুক্তমত