Monday 13 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নৌকা ভাড়া ৫০ হাজার টাকা এবং মানবিকতার গল্প

আজহার মাহমুদ
২০ জুন ২০২২ ২১:৪৮ | আপডেট: ২১ জুন ২০২২ ০৮:৫৯

আষাঢ় মাস বৃষ্টির মাস। এই মাসেই বন্যা সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা, দুঃখ, কষ্ট, দুর্ভোগ। সিলেটে প্রতি বছরের মতো এবারও বন্যা হয়েছে। তবে এবারের বন্যার মাত্রা বেশ ভয়ংকর। । ১২২ বছরের রেকর্ড ভাঙা এই বন্যায় ক্ষতির পরিমাণও অনেক। সিলেটের মানুষ ভালো নেই, ভালো নেই সুনামগঞ্জ। এই ভালো না থাকার সারি বাড়তে থাকবে হয়তো। সেইসঙ্গে কয়েকদিন টানা ভারি বর্ষণ। এতে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে। তাতে আশংকা হচ্ছে আরও মারাত্মক কিছু হবে। তবে আশংকা যেন সত্যি না হয় সেই কামনা করি।

বিজ্ঞাপন

ভয়াবহ এই বন্যায় সবার নজর থাকছে মানুষ ও সম্পদের ক্ষতির দিকে। কিন্তু পশু-পাখিদের জীবন এবং পরিবেশও যে হুমকির মুখে, সেটি দেখার কেউ নেই। এই বন্যায় সিলেটের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মহাবিপদে পড়েছে পোষা ও বন্যপ্রাণীরা। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগতভাবে গড়ে ওঠা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ও হাঁসের খামার ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।

গত ১৯ জুন জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ। ৭২টি ইউনিয়নে প্লাবিত চারণভূমির পরিমাণ ৫ হাজার ৭৭৪ একর। গবাদি খামার, হাঁস-মুরগির খামার, কৃষি ভূমি ও দানাদার খাদ্য, নষ্ট খড় ও ঘাস ও মৃত পশু-পাখি মিলিয়ে মোট ক্ষতি আড়াই কোটি টাকারও বেশি। বন্যায় সিলেটে ক্ষতিগ্রস্থ মোট গরুর সংখ্যা ২ লাখ ৮১৩টি, মহিষ ২৬ হাজার ৮৭৭টি, ছাগল ৪৮ হাজার ৪১১টি, ভেড়া ১৮ হাজার ১৫৫, মুরগি ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩৯টি ও হাঁস ২ লাখ ৪৪ হাজার ১৯২টি। এর মধ্যে মারা গেছে, গরু ১১টি, মহিষ ৫টি, ছাগল ২৪টি, ভেড়া ১০টি, মুরগি ২ হাজার ৭১৫টি ও হাঁস ৪৯১টি।

অনেকের মতে, সিলেটের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। উজানের সেই পানি প্রবেশে করছে সীমান্তবর্তী সিলেটে। তাদের বাঁধ খুলে দিয়ে আমাদের দেশে সমস্ত পানি ছেড়ে দেয়। যা আমাদের হাওর অঞ্চলগুলো ডুবিয়ে দেয়। তবে এই দায় কিছুটা সরকার, প্রশাসনের উপরেও এই বর্তায়। এটুকু পর্যন্ত দায় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দায়টা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে কিছু অমানুষ, অমানবিক পশুর দিকে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। একজন মানুষ আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকার জন্য চিকিৎসা করা হলো না। এবং সেই লোকটি মারা গেলো। আশা করি এই উদাহারণের মাধ্যমে বুঝাতে পেরেছি আমি কাদের কথা বলছি।

বিজ্ঞাপন

এানুষ যখন পানিতে সবকিছু হারিয়ে জীবন বাঁচাতে ছুটছেন তখন একদল পশু এসে ব্যাবসা করছে মানুষের জীবন নিয়ে। ৫০/১০০ টাকার নৌকা ভাড়া ৪০/৫০ হাজার টাকা দাবি করে তখন সত্যি অবাক লাগে এরা কি মানুষ নাকি পশু। গণমাধ্যমের বরাতে জানতে পারলাম, একজন গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করতে গিয়ে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছেন স্বামী। কিন্তু ৫০ হাজারের নিচে যাবেন না নৌকার মাঝি। কি অদ্ভুত! একটি মোমবাতির মূল্য একশত টাকা। ৫ টাকার জিনিস ১০/১৫ টাকা হলেও মানা যায়। কিন্তু দুই হাজার শতাংশ বাড়িয়ে ১০০ টাকা দাম রাখা কতটা জঘন্য মনের কাজ সেটা ভুক্তভোগীদের জায়গায় আপনি আমি থাকলে বুঝতে পারতাম।

যেখানে বিভিন্ন সংগঠন, বাইরে থেকে মানুষজন গিয়ে টাকা পয়সা, ত্রাণসহ ইত্যাদি সাহায্য দিচ্ছে সেখানে কীভাবে এইসব মানুষ নামক পশুদের বিবেক জাগ্রত হয় না। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেট, সুনামগঞ্জের মানুষকে সাহায্য সহযোগিতার অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। লেখক, গায়ক, অভিনেতা, সংগঠক বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করছে। অনেকেই সেসব টাকার হিসেবও দিচ্ছে অনলাইনে এসে। অনেকের আবার হিসেব নাই। কথা হচ্ছে এইসব টাকা নিজের ব্যাক্তিগত খরচের জন্য নয়। তাই কেউ অসহায় মানুষের কথা বলে নিজের পকেট ভারি করবেন না। তবে আমার ব্যাক্তিগতভাবে সংগীতশিল্পী তাশরূফ খান ও তার ব্যান্ড কুড়েঘরের সদস্যদের কার্যক্রম ভালো লেগেছে। খুবই সচ্ছতা এবং সততার সাথে তাদের কাজ করা হয়। অসুস্থ হয়েও মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তারা। সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় তাশরীফ জানায়, তাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৬ লক্ষ টাকা এসেছে। এই টাকাগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী কিনে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবে আরও অনেক সংগঠন এবং ব্যাক্তি উদ্যোগে মানুষকে সহযোগিতা করছে। যা সত্যি প্রশংসনীয়। এইসব মানুষ আছে বলেই আজও বাংলাদেশ টিকে আছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি উন্নত দেশের আগে একটি মানবিক দেশ গড়া খুব জরুরী। যেখানে মনুষ্যত্ব নেই, মানবতা নেই- সেখানে উন্নয়ন দিয়ে কি হবে!

তবে সিলেটের কিছু মানুষ যেন এই কঠিন সময়ে সবচেয়ে বেশি অমানবিক হয়ে পড়েছেন। তাদের ব্যাবসায়ীগণ সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাশরীফ খান তার এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, সিলেটের ব্যাবসায়ীগণ যদি একটু মানবিক এবং উদার হতেন তাহলে ভালো হতো। এখানে সবকিছুর দাম অনেক বেশি। তাই এখান থেকে কিছুই কিনতে পারছেন না । ঢাকা থেকে কিনে এখানে নিয়ে আসতে হচ্ছে।

এই অমানবিকতার গল্প এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষটা আরও ঘৃণ্য। এই কঠিন ভয়ংকর পরিস্থিতে মানুষকে আরও ভয়ংকর সময় পার করতে হচ্ছে। একদিকে পানির স্রোত, অন্যদিকে ডাকাতের হানা। ভাবতেই কেমন যেন গা শিউরে উঠে। কি ভয়ংকর অবস্থা। মানুষ কতটা নির্দয় হতে পারে সেটা এই বন্যা পরিস্থিতে বুঝতে পেরেছে সিলেটের অসহায় মানুষ।

পরিশেষে বলতে চাই, আসুন মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াই, মানুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাই। মনে রাখতে আজ আপনি অন্যের বিপদে ফায়দা লুটছেন. ক্ষতি করছেন সেটা আপনার বিপদে অন্য কেউ করবে। মনে রাখবেন সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেয়, ছেড়ে দেয় না।

লেখক : প্রাবন্ধিক এবং কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

আজহার মাহমুদ নৌকা ভাড়া ৫০ হাজার টাকা মানবিকতার গল্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর