সীতাকুণ্ড ট্রাজেডি ও মালিকপক্ষের দায়
৭ জুন ২০২২ ১১:২৪
গত রোববার দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দেশ শোকে মাতম। মৃত্যুর মিছিল শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ লেখাটি লেখা পর্যন্ত সবশেষ ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত প্রায় পাঁচ শতাধিক। নিখোঁজ আরও অনেকেই। অনেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গে ভীড় করছেন আপনজনের শেষ অস্তিত্বটুকুর সন্ধানে।
আগুন ধরার প্রথম পর্যায়ে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল না। আগুন যখন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখা কনটেইনারে দিকে ধাবিত হয় তখনই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিকট শব্দে আশপাশের ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কেঁপে ওঠে। বিস্ফোরণ এতটা ভয়াবহ ছিল যে আশপাশের ভবনসমূহের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে যায়।
বিএম কনটেইনার ডিপো চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘স্মার্ট গ্রুপের’। ওই ডিপোতে রাখা ছিল ভয়াবহ দাহ্য কেমিক্যাল পদার্থ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। যার ফলে পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। জানা যায়, ডিপোটিতে ভয়ঙ্কর দাহ্য কেমিক্যাল পদার্থ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখার কোনো প্রকার অনুমতি ছিল না। তাছাড়া ডিপোটি লোকালয়ের পাশে অবস্থিত। লোকালয়ের পাশে অবস্থিত কোনো জায়গায় এমন ব্যাবসার জন্য এমন রাসায়নিক পদার্থ রাখার কোনো নিয়ম নেই।
এ রাসায়নিক পদার্থের ভয়াবহতার কারণেই পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তা এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাছাড়া ঘটনার এত ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখনো মালিকপক্ষ ঘটনাস্থলে আসেনি এবং কনটেইনার ডিপোতে কোন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে তা জানায়নি। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না উদ্ধারকারীরা।
চারিদিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ, বিভিন্ন সংগঠন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মধ্যরাতে ক্যাম্পাস থেকে ছুটে গিয়ে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা রক্ত দিয়েছে, হাসপাতালে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। দেশের যেকোনো দুর্যোগ, দূর্ঘটনা আর সংকটে এদেশের ছাত্রসমাজ সবার আগে এগিয়ে আসে। সীতাকুণ্ডের এ ঘটনা তা আরেকবার প্রমাণ করে দিল। এসব মানুষদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও স্যালুট।
সীতাকুণ্ডের ঘটনায় বেসামরিক লোকজন ছাড়াও অনেক ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হয়েছেন। লোকালয়ের পাশে অনুমতি বিহীন হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো ভয়ংকর দাহ্য পদার্থ রেখে এতোগুলো মানুষের করুণ মৃত্যুর দায়ভার কি স্মার্ট গ্রুপ নিবে! হবে কি শাস্তি? দেখা যায়, এদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষের যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার সঙ্গে দহরম-মহরম থাকে। স্মার্ট গ্রুপের মালিকও বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের একটা পদের অধিকারী। দিনশেষে মানুষখেকো এসব শীর্ষ রুই—কাতলাদের কিছুই হয় না। তারা টাকা ও ক্ষমতা দিয়ে সব ‘ম্যানেজ’ করে নেন। আর টাকা আর ক্ষমতার কাছে হেরে যায় আমাদের বিচারব্যবস্থা।
সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বাস্তবতায় আরেকটি বিষয় আলোচনা করার প্রয়োজনবোধ করছি। তা হলো—এদেশের ফায়ার সার্ভিস জন্য উন্নত ও আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চিত করা। এদেশের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু তাদের বহরে এখনো উন্নত ও আধুনিক সরঞ্জাম নেই। তাদের বহরে হেলিকপ্টার, উচ্চতা সম্পন্ন ইমার্জেন্সি মই, আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত হবে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় তারই বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।
বাংলাদেশ এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রায় এ দেশকে বিভিন্ন দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। আর ফায়ার সার্ভিস তখন প্রাণভোমরা হয়ে দাঁড়ায় মানুষের মাঝে। খিচুড়ি রান্না, পুকুর খনন শেখা, রেললাইন দেখা ইত্যাদি অমূলক কাজে সরকারের অনেক অর্থই তো অপচয় হয়। এবার না হয় ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর আধুনিকায়নে এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে কিছু অর্থ ব্যয় হোক। এটা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
সীতাকুণ্ড ট্রাজেডিতে অনেক মায়ের বুক খালি হয়ে গেল; কারও বাবা, কারও বন্ধু, কারও ভাই, কারও স্বামী এবং কারও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটাও অকাল এই করুণ মৃত্যুর শিকার হলো। একজন বিএম ডিপোর মালিকের অসাবধানতা বা অতি মুনাফালোভী মানসিকতার জন্য আজ কতগুলো মানুষ বিভীষিকাময় অকাল মৃত্যুর শিকার হলো। শেষমেষ মানুষখেকো এসব শীর্ষ রুই—কাতলাদের কিছুই হয় না। কিন্তু যার চলে যায় সেই বুঝে চলে যাওয়ার বেদনা কেমন!
ইতোমধ্যে সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তা শেষমেষ আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েই যায়। দেখা যায়, তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিবেদন পেশ হয় কিন্তু হয় না বিচার। আমার চাই, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। এতোগুলো মানুষের করুণ মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হোক। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মতো এমন বিভীষিকাময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না হোক— এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি