পুলিশি ইভটিজিং— ‘টিপ পরছস কেন?’
৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৩০ | আপডেট: ৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৩২
ইভটিজিং যে কোনো সমাজ ব্যবস্থার একটি মারাত্মক ব্যাধি। বিশেষ করে আমাদের দেশের নারীরা ইভটিজিং শব্দের সাথে বেশ পরিচিত। কারণ রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রেও নারীদেরকে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। এ যেন পুরুষশাসিত সমাজের কাঠামোগত সহিংসতায় শিকার নারী সমাজ।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেছেন, ‘শ্রমজীবী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক— সব ধরনের পেশায় নিযুক্ত নারীই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’ তিনি যথাযথেই বলেছেন কারণ যে রাষ্ট্রযন্ত্রে একজন কলেজ শিক্ষিকাকে ইভটিজিং এর শিকার হতে হয় সেই রাষ্ট্রে নারীরা কতটুকু নিরাপদ তা উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংসদ কিংবা পত্রিকাসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ঝড় ওঠেছে। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার কলেজ যাওয়ার পথে তাকে উদ্দেশ্য করে এক পুলিশ ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই অকথ্য ভাষায় গালি দেন। পুলিশ রাষ্ট্রের সেবক অর্থাৎ জনগণের নিরাপত্তাকারী। জাতি তৈরীর কারিগর শিক্ষক। দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান শিক্ষক। এবার সেই মহান পেশায় নিয়োজিত একজন শিক্ষককে যখন পুলিশের দ্বারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হন তখন এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!
শরীর যার সিদ্ধান্ত তার, পুলিশের কী বলার অধিকার আছে? ওরা পুলিশ হোক কিংবা রাস্তার টোকাই হোক। ওদের রক্তে মাংসে গড়া শরীর এক অসুস্থ সমাজের পুরুষ ওরা। গ্রাম কিংবা শহরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ভরে আছে। নারী টিপ পরবে না–কি পরবে না। সেটা তো কারো বলার অধিকার নেই। টিপ পরা আমাদের দেশের সংস্কৃতি। শিশু কিংবা বৃদ্ধা অথবা কিশোরী কিংবা যুবতী। কেউ রেহাই পায় না পুরুষের চোখে। কেউ ধর্ষকের মতো তাকায়। কেউ দর্শকের মতো তাকায়, ওরা কথায় কথায় উপদেশ ছাড়ে মাথায় ঘোমটা দাও। উচ্চ কণ্ঠে কথা বলো না, মাথা নিচু করে পথ চল। ধর্ষণ হলে প্রতিবাদ কেন কর? পুরুষতন্ত্রের এ মানসিকতা কেন তৈরী হয়? ছোটকাল থেকে পুরুষদের এ মানসিকতায় গড়ে তোলার জন্য আজ নারীর প্রতি বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘সিডও সনদ’ বা ‘নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ’ গৃহীত হয়। এই সনদকে বল হয় ‘উম্যান’স বিল অব র্যাবিটস’। এতে ৩০টি ধারা রয়েছে। ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী–পুরুষের সমতা সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে নারী–শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিনের খবর। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন নির্যাতন, হত্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাহাড়ে–সমতলে, ঘরে–পথে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলে–কারখানায় থেকে শুরু করে ঘরে বাইরে যেকোনো জায়গায় দিনে কিংবা রাতে নারীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
রাজপথে মিছিল ও সমাবেশ চলে। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলে নারী নির্যাতনকারীদের বিচার চাই। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন রাষ্ট্রকে চেপে ধরে আছে নারী নিপীড়কদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায় না। তাহলে স্বাভাবিকভাবে নারী জাতি প্রশ্ন তুলতে পারেন রাষ্ট্র তাহলে কাদের পক্ষে? যেই রাষ্ট্র ধর্ষক পুষে, সেই রাষ্ট্র চায় না নারীসমাজ। নারী ধর্ষণ হলে পুরুষ সমাজ নারীর কাঁপড় খুঁজে, নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কেউ ধর্ষক, কেউবা দর্শক সাজে। নারীরা অর্থনৈতিক শোষণ ও ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দ্বারা নির্যাতিত। যে সমাজ নারীর মর্যাদা দিতে জানে না, সেই সমাজকে সুস্থ বলা যায় না। অসুস্থ সমাজে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে বিকৃত মানসিকতায়। যার ফল ভোগ করতে হয় গোটা জাতিকে।
আমাদের দেশে নারী শিক্ষার উন্নয়ন হয়েছে। নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে প্রায় সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। ঘর–সংসার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে তথা সবক্ষেত্রেই নারীরা অপরিসীম ভূমিকা রাখছে। নারী রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অগ্রণী। পুরুষের পাশাপাশি সব কাজে, খেলাধুলায় নারীরা অংশগ্রহণ করছে। নারী পর্বত জয় করছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে পরপর দুই মেয়াদে নির্বাচিত হলেন একজন নারী। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর, নৌবাহিনীর মতো সশস্ত্র পদে কাজ করছে নারীরা। কেবল সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পদে নয়, নারী আজ সব ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। নারীদের এই সফলতার গল্পের পেছনে হাজারো মা–বোনের কান্না তা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নারী নির্যাতন বেড়েছে। শুধু কী বিচারহীনতায় দায়ী না আর কিছু বিষয় আছে যার কারণে নারীরা নির্যাতিত হয়। তবে নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ হিসাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরে দায়ি হলো– ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। যা সমাজে প্রতিটি স্তরে অবস্থান করছে। বিশেষ করে ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার লোকদের মন্তব্য দেখে উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে। আজকে কোন পথে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা? অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার জন্য দীর্ঘ নয়মাসের রক্তে রঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ ভালো নেই। নারীকে মানুষ হিসাবে দেখে না পণ্য হিসেবে দেখে। ভোগবাদী মানসিকতায় ছেয়ে আছে গোটা সমাজ।
জাতির নৈতিক অধঃপতনের এই ক্রান্তিলগ্নে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। সম্পত্তিতে নারীর সম–অধিকারের দিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। কলেজ শিক্ষিকাকে হেনস্তা ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া ওই পুলিশকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আনতে হবে যাতে ওই ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই ওগো হে হতভাগা জাতি কেন ভুলে যাও, মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। কেন ভুলে যাও পাকিস্তানের শোষণ আর বাঙালির সংস্কৃতির উপর আঘাতের কথা। পাকিস্তান শোষক রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করতে চেয়েছিল তার বিরুদ্ধেও বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আমার সোনার বাংলায়, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়; নারীর টিপে আঘাত মানেই বাঙালির সংস্কৃতির উপর আঘাত। নারীর কপালের টিপে আঘাত মানেই বাংলায় মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর আঘাত। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে চক্রান্ত শুরু করেছে ধর্মান্ধ আর মৌলবাদীর দল। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকিরসহ প্রগতিশীল লেখকের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে দেওয়ার স্লোগান তুলেছে। নারীকে বেড়াজালে আটকে রাখতে চায়, ওরা ধর্মব্যবসায়ী, ব্যবসা করা ওদের পেশা। ওগো হতভাগা জাতি সাবধান। মোদের দেশে মোদের ভাষা, মোদের সংস্কৃতি, দেশকে গড়ে তুলি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই