ঈদ মুবারক, প্রিয় নাঈমা আরা হোসেন
১ আগস্ট ২০২০ ১১:৩০ | আপডেট: ১ আগস্ট ২০২০ ১৩:৪৪
মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু অমোঘ, অলঙ্ঘনীয়। মৃত্যুদূত ঠিকঠাক বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে সময় মেনে। প্রবল অনাকাঙ্খিত মৃত্যু পরোয়ানা ঠিকঠাক আসে বর্ষা, শীত বা হেমন্তের হিমেল ভোর অথবা চাঁদনী রাতে। মহাকালের পরিক্রমায় হয়তো মৃত্যুই একমাত্র চূড়ান্ত গন্তব্য। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে পেতে হয়, স্বজন বা ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু শোক সইতে হয় সবাইকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয় কারও না কারও মৃত্যু শোক।
বয়সের যাত্রায় নিজেকে বেশ পরিণত বলা যায়। তাই সব মৃত্যুই আগের মত শোকার্ত করে না। যুক্তিবাদী মন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আর ব্যস্ততা অনেক প্রিয়জন হারানোর শোক খুব দ্রুত ভুলিয়ে দেয়। তবে কিছু মৃত্যু মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে দীর্ঘদিন। কারণে-অকারণে হঠাতই সেই মানুষের জন্য বুকের গহীন থেকে বের হয় দু-একটি দীর্ঘশ্বাস। শব্দহীন ভাষায় উচ্চারিত হয় আহা, সোনার মুনষটা! চলে গেলেন!
সম্প্রতি একটি মৃত্যু বেশ আচ্ছন্ন করেছে। বৃষ্টি ভেজা সকালে যখন খবরটি পেয়েছিলাম, কোন অবস্থাতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। তাঁর চলে যাওয়া এখনও ব্যাথা জাগায়। মন খারাপ করে। ঈদের বাজার করতে হাতিরপুল যাওয়ার পর আবার কষ্টটা মনের ভেতর নতুন মোচড় দিলো। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম মোতালেব প্লাজার দিকে। খুব দেখতে ইচ্ছা করলো প্লাজার পেছনে আবাসিক অংশের ১১ তলার ঐ ফ্লাটটি এখন কেমন আছে? অধ্যাপক গোলাম রহমানের স্যারের সান্নিধ্যে ঐ ফ্লাটে গেলে এখন কে দরজা খোলেন? ঐ ফ্লাটের সবকিছুতেই তো একজন নাঈমা আরা হোসেনের যত্নের পরশ লেগে আছে। ভবনটির লিফট, ফ্ল্যাটের দরজা, রান্নাঘর, খাবার টেবিল, বিছানার নরম জমিন কী এখনও অভিমান করে অপেক্ষায় আছে একজন মমতাময়ীর জন্য। যার হাতেই গড়া একটি সংসারের সব কিছু।
নবিস আর নগণ্য অনেক গবেষকের অনেক কাজ দেখিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক গোলাম রহমান। ঐ বাড়িতে খাবার টেবিলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করেছি। আদরের আপ্যায়নের সাথে কাজ করতে করতে অনেক দিন খাবারের সময় হয়েছে। স্যারের সাথে ভাত খাওয়ার (প্রবল ইচ্ছা থাকলেও) আমন্ত্রণ পেয়েও কয়েকদিন প্রবল সংকোচে খেতে বসিনি। তবে বেশি দিন ফাঁকি দিতে পারিনি। একজন পরম মমতাময়ী নাঈমা আরা হোসেন জোর করে খাইয়েছেন পরপর কয়েকদিন। পিতৃ সমতূল্য শিক্ষকের সাথে বসে দুপুরের খাবার খেতে পারা যে কতবড় সৌভাগ্য, কতটা তৃপ্তির বলে বুঝাতে পারবো না। এই স্মৃতি কেমন করে ভুলি, আন্টি!
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান স্যারের সান্নিধ্য যারা পেয়েছেন তারা সবাই নাঈমা আরা হোসেনকে চেনেন। তাঁর ভেতরে সবাইকে খুব দ্রুত আপন করে নেওয়ার সহজাত প্রবণতা ছিল। আর কেমন যেন মায়াবী প্রাণখোলা একটা হাসি হাসতেন। সেই হাসিতে অলৌকিক এক ঝঙ্কার ছিল। এখনও সেই হাসিমুখ ভুলতে পারি না। আমি ও আমার স্ত্রী (পেশায় শিক্ষক) নানা কারণে অধ্যাপক গোলাম রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছি। আর ভীষণভাবে পেয়েছি নাঈমা আরা হোসেনের আতিথেয়তা ও পরামর্শ। আমার স্ত্রীকে বিভিন্ন বিষয়ে কত আপন করে, স্নেহ দিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। একটি পরিবার গঠন করতে কত কী করতে হয়, কত কী মেনে চলতে হয়… আহা। আন্টি আপনি চলে গেলেন। এত দ্রুত!
আমার দেখা এই ছোট্ট জীবনে অধ্যাপক গোলাম রহমান একজন পুরোপুরি পরিবার নিবেদিত মানুষ। যে মানুষের পাঁজরের অংশ ছিলেন নাঈমা আরা হোসেন। দীর্ঘ জীবনে আপনাদের একসাথে পথ চলার কাহিনী ভীষণ রোমাঞ্চকর। যা আমাদের সাহস জোগায়। একটি ভালো, অটুট বন্ধনের পরিবার গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আপনি চলে গেলেন। কেমন আছেন আমার স্যার? আমার সাহস হয় না, স্যারের দিকে তাকানোর। আপনি ছাড়া স্যার দেখতে কেমন? আমি ভাবতেই পারি না। বিশ্বাস করেন আপনি ছাড়া স্যারকে আমি দেখতেও চাই না !
ওপারে আপনি কেমন আছেন? নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আপনাকে ভাল রেখেছেন। সম্মানিত জায়গার আছেন। আমরা আছি আপনার স্মৃতি নিয়ে। আপনাকে ছাড়া এবার অনেক মানুষ ঈদ করবে। বিশ্বাস করেন, আপনার স্নেহ আর ভালোবাসার পরশ সবাই ভীষণ মিস করছে। খুব সামান্য হলেও আমিও আছি সেই দলে।
মৃত্যুকে আটকে রাখার শক্তি কারও নেই। কালের নিয়মে আসা-যাওয়া চলবেই। আজ শুধু প্রার্থনা একটাই, আপনি যাতে আবার আপনার পরিবার ফিরে পান। কোন সুশোভিত বাগান বা সমুদ্র তীরে আপনি যাতে আবার আপনার পরিবার গুছিয়ে নিতে পারেন, আরেকবার।
ঈদ মুবারক নাঈমা আরা হোসেন! ঈদ মুবারক নাঈমা আরা হোসেনের পরিবারেরর সবাইকে!
(লেখক: অধ্যাপক গোলাম রহমানের শিক্ষার্থী, নাঈমা আরা হোসেনের স্নেহধন্য)