Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা মহামারি মোকাবেলা; অস্বচ্ছতার পর্দায় ক্ষতি বেশি


৪ জুলাই ২০২০ ১৪:৩১

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। যেহেতু বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সমস্ত রোগীর জন্য চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা কঠিন; তাই কর্মীদের সহায়তার জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে এবং অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। আর এসব করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চাপা পড়ে যাচ্ছে; তা হলো জনগণের জানার অধিকার।

এই মহামারিতে ঠিক কত লোক আক্রান্ত/ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই তথ্য থেকে শুরু করে অর্থনীতির কোন ক্ষেত্রে কীভাবে ও কী পরিমাণ সহায়তা করা হচ্ছে তা জনগণের জানা প্রয়োজন। অথচ সংকট চলাকালীন জনগণের জন্য প্রয়োজন এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে তাদের সচেতন করার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো তথ্যের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করছে এবং নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে বিদ্যমান জবাবদিহিমূলক উন্মুক্ত আইনগুলোকে গুরুত্বহীন বা মন্দ আইন হিসেবে বিবেচনা করছে ও প্রতিনিয়ত সেগুলো সীমিত/লঙ্ঘন করছে।

বিজ্ঞাপন

সর্বত্রই বিরাজ করছে গোপনীয়তার ঘেরাটোপ

সারাবিশ্বেই মৃত্যুর পরিসংখ্যান, আক্রান্তের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য সরঞ্জামের অভাবকে চাপা দেওয়া হয়েছে। বড় বড় কোম্পানির জন্য ভর্তুকির বিষয়ে সর্বজনীন মতামত দেওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে; গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সংগ্রহের চুক্তি দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোকে এবং অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ছায়া গোষ্ঠীগুলো দিচ্ছে বিজ্ঞানের পরামর্শ। টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলো এবং নতুন নতুন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সাধারণ মানুষের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে; অথচ কী সংগ্রহ করছে এবং কীভাবে সেসব ডাটা ব্যবহার করছে তা প্রকাশ করছে না।

বিজ্ঞাপন

একই সঙ্গে তথ্যের অধিকার এবং জবাবদিহিমূলক অন্যান্য উন্মুক্ত আইনের বাস্তবায়ন ব্যাহত করা হয়েছে। সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া রাষ্ট্রীয় নেতারা দাবি করছেন যে, সঙ্কট সম্পর্কিত তথ্য আসলে ‘ক্লাসিফাইড’ (আইন দ্বারা সুরক্ষিত গোপনীয়তা) স্তরের। সরকারের স্বচ্ছতার অভাব ও এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো প্রকাশের জন্য হুইসেল ব্লোয়ার ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে তাদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

স্বচ্ছতার অভাবের সমস্যাটি জাতিসংঘের সর্বত্র গিয়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, “এখন এমন সময়, যখন জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারগুলোকে আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশি উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ, তৎপর ও দায়বদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।’’

২০০৫ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধিমালা অনুসারে সংকটের সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তথ্য সরবরাহে প্রতিটি সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ সেই একই তথ্য নিজেদের নাগরিকদের অবহিত করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুরূপ বাধ্যবাধকতা বিষয়ে বিধিমালায় কিছু বলা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কেবল অপরাপর উৎস হতে পাওয়া তথ্য জনগণের জন্য প্রকাশ করতে পারে। এমনকি গত দুই দশকে বেশ কয়েকটি মহামারির পরেও রাষ্ট্রগুলোর কি প্রকাশ করা উচিত সে সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোন গাইডলাইন বা নির্দেশিকা নেই। এ কারণে মৃত্যু হারের বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা এবং মানদণ্ড ব্যবহার করে, যা তাদের মধ্যে বিরাট মতভেদ এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বাস্থ্য ব্যয় সম্পর্কে কি প্রকাশ করবে; এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যেন কিছু বলার নাই। সর্বোচ্চ যা করে তা হলো, তাদের রিস্ক কমিউনিকেশন গাইড উত্তম জনসংযোগ কৌশলের বিষয়ে পরামর্শ দেয়। অথচ কী কী স্বচ্ছ হওয়া উচিত সে সম্পর্কে কোনও নির্দেশনা এতে নাই।

তদুপরি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিজেদের তথ্যে প্রবেশগম্যতার নীতি (একসেস টু ইনফরমেশন পলিসি) গোপনে প্রদত্ত তথ্য জনম্মুখে প্রকাশ করা বা যা কিছু “সদস্য রাষ্ট্র বা অন্য আন্ত:সরকারি সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে” তার প্রকাশ নিষেধ করে। এক্ষেত্রে জনস্বার্থ এবং কোন বাহ্যিক আবেদনও বিবেচনা করা হয় না।

এই গোপনীয়তা হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনে। এটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, অবিশ্বাস এবং দরকারি জনস্বাস্থ্য প্রচেষ্টায় চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়। এটি কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে অব্যাহত অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অনুমোদন দেয়। জন আস্থা নিশ্চিত করতে সংকটের সময় পূর্ণ মাত্রায় স্বচ্ছতা এবং সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য কি কি করা হচ্ছে তা জানানো অপরিহার্য। এটি সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ এবং নতুন নীতি পদ্ধতি আলোচনার সক্ষমতা তৈরি করে। এছাড়া যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের কাছে যাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছায় তাও নিশ্চিত করে।

১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারিটি বিশ্বব্যাপী মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর কারণ জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগের আশঙ্কা যুদ্ধকালীন সরকারগুলোকে ভীত করে তোলে এবং তারা গোপনীয়তা ও প্রোপাগান্ডার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কেবল স্পেন, যারা সে সময় নিরপেক্ষ ছিল, মহামারির প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে।

আর্টিকেল নাইনটিন বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার আলোকে সম্প্রতি স্বচ্ছতা বিষয়ক একটি নীতি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য তথ্য থেকে শুরু করে সরকারি ব্যয়, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পর্যন্ত যে সব তথ্য সরকারের সরবরাহ করা উচিত সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য কীভাবে প্রকাশ করতে হবে এবং সেই প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য কোন কোন অপরিহার্য সরকারী সেবা সচল রাখা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

যেহেতু আমরা আমাদের জনসমাগম স্থল, অফিস এবং মার্কেট খুলে দেওয়ার কথা ভাবছি; তাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি বুঝতে আমাদের সবার আগে প্রয়োজন গোপনীয়তার ঘেরাটোপ থেকে সরকারগুলোকে উন্মুক্ত করা। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায়গুলোতে সম্মত হওয়ার জন্য এটা জরুরী। অন্যথায়, আমরা ঘুরেফিরে সেখানে গিয়েই থামব; যেখান থেকে শুরু করেছিলাম।

(ইংরেজি থেকে অনূদিত)

লেখক: হেড অব ট্রান্সপারেন্সি, আর্টিকেল নাইনটিন আন্তর্জাতিক কার্যালয়, যুক্তরাজ্য

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর