প্রথম বিশ্বের কোভিড: সুখের অসুখ, অসুখের সুখ!
১৫ মে ২০২০ ০৬:৩৮ | আপডেট: ১৫ মে ২০২০ ০৭:০৬
প্রথম ধাক্কাটা গিয়েছিলো চায়না টাউনের উপর দিয়ে। গত শতাব্দীর গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি দোকানগুলোতে কমে এসেছিলো ভিড়, রেস্তোরাগুলোর মেনুতে মেনুতে জমতে শুরু করেছিলো ধুলো। ফুটপাথে কার্ডবোর্ড কিংবা প্লাস্টিকের পাটাতনে দুকুচি চিংড়ি, কয়েক আঁটি সব্জি আর এক দুই ঝুড়ি রামবুতাম সাজিয়ে বসে থাকা অতিবৃদ্ধ গৌশিন লীর মুখের চামড়ার একশ হাজার ফাটলে তখন তিনশ হাজার ভাবনা। নিয়ন বাতির আধো আলো আধো অন্ধকারে একটু কান পাতলেই যেন শোনা যাচ্ছিলো আতংকের পদধ্বনি।
এমনি এক সন্ধ্যায় ক্যানাডার স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্যাটি হায়ডু, অন্টারিওর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্রিস্টিন এলিয়ট, টরন্টোর মেয়র জন টোরি, এবং আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যাক্তির পদধূলি পড়লো চায়না টাউনে। বুম হাতে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা বললেন, ‘আমাদের দেশে, এই শহরে, বৈষম্যের কোনো স্থান নেই’। এটা ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখের কথা। করোনা তখনও কোভিড হয়নি, সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত কেবল তেতাল্লিশ হাজার, এক চায়নাতেই বেয়াল্লিশ হাজার ছয়শ আটত্রিশ! উহান শহরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে জিংপিং সবে গুণতে শুরু করেছেন লাশের মিছিল- এক, দুই, তিন, ……এক হাজার ষোল।
মন্ত্রী-মেয়রের কথায় কাজ হয়নি। সে এক অদ্ভুত সময় তখন। পথের বাঁকে, দোকানে, ক্যাফে আর রেস্তোরায় চীনা মানুষ, সে চেনাই হোক কি অচেনা, দেখলে আমি জড়সড় হয়ে যাই। খুব সাবধানে, যেন সে টের না পায়, একটু পিছিয়ে গিয়ে মনে মনে ভাবি, ‘বলা তো যায়না, এ যদি উহান থেকে এসে থাকে’! ভদ্রতার মুখোশে নিজের শঙ্কাকে আড়াল করে ঘরে ফিরে চোখ রাখি টেলিভিশনের পর্দায়। একটা সাবওয়ে স্টেশনে কিছু মানুষের জটলা। রাজ্যের বিষণ্ণতা নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির একটি তরুণী। মেয়েটির ভ্রমণ সাথী বর্ণনা করছেন একটু আগেই ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার কথা-
“চলে যাও বাদুড়খেকো, এ শহর তোমাকে চায়না কুত্তী।”
আমি টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মধ্যবিত্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার স্ত্রীকে বলি, ‘শহরের মানুষগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে দেখেছো!’
তারপর পেরিয়ে গিয়েছে আরও তিনমাস। করোনা এখন কোভিড, পৃথিবীজুড়ে আক্রান্ত প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ, গোনা হয়ে গিয়েছে তিন লক্ষ শবদেহ। আমরা চেষ্টা করছি যতোটা পারা যায় ঘরে থাকার। আর যদি বের হই, তাহলে মাস্কের আড়ালে মুখ ঢেকে দ্রুতগামী পরিযায়ী পাখির মতো গন্তব্যে পৌঁছে ফিরে আসি আরও দ্রুত। কী যে দিন এলো ভাইডি, সমাজে আর মুখ দেখানোর কোনও উপায় নেই!
আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে একটি তুর্কি পরিবার। ওদের তিনটে বাচ্চা। বাচ্চাগুলো ব্যাকইয়ার্ডে হুটোপুটি করে খেলে। একদিন ওদের বাস্কেটবলটা পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে পড়লো আমাদের বাগানে। আমি তুলে ফেরত পাঠালাম। বাচ্চাদের একজন দৌড়ে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ঘরের জানালা থেকে ওদের মা তুর্কি ভাষায় কী যেন একটা বলছেন। তুর্কি না জানলেও আমি বুঝতে পারলাম তাঁর শঙ্কা। সার্স-কোভ-টু প্লাস্টিকে টিকে থাকে তিন দিন। ভাগ্যিস হ্যান্ড স্যানিটাইজারটা সেদিন আমার পকেটেই ছিল!
এ শহরে অনেক মানুষ। তাদের কেউ ভীরু, কেউ সাহসী, কেউ নিরুপায়, কেউ কেউ অদৃষ্টবাদী। আমি অদৃষ্টবাদী নই, সাহসের পরীক্ষাও আমাকে দিতে হচ্ছে না। বাসায় বসে অফিস করার সৌভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে দিতে ভাবি গরমটা আরেকটু বাড়ুক, চলে যাক আরও কয়েকটা দিন। একটা না একটা উপায় বেরিয়ে যাবে নিশ্চয়ই, হয় ওষুধ, নয় প্রতিষেধক। পৃথিবী জুড়ে এতো এতো মেধাবী মানুষের রাতদিন পরিশ্রম বৃথা যেতে পারে না।
বাসায় বসে থেকে থেকে মুটিয়ে গিয়েছি, আমার ভাবনা নেই। মাথার এলোমেলো চুল চোখের উপর এসে পড়ে থাকে, আমার বিকার নেই। জ্বালাচ্ছে কেবল দুটো জিনিস। এক, চোয়ালের ভেতরের দিকে কদিন ধরে শিরশির করে চলা একটা দাঁত। দুই, রেস্তোরায় গিয়ে ভালমন্দ কিছু খাবার তীব্র একটা বাসনা। কিন্তু কিছুই করার নেই, ডেন্টিস্টের অফিস বন্ধ, রেস্তোরার দরজায় তালা। এই ধরনের নানবিধ খুচরো সমস্যা নিয়ে বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলি মাঝে মাঝে। ওদের কেউ কেউ আবার সন্ধ্যার পর আড্ডা দেয়। সশরীরে নয়, ল্যাপটপ-ফোন কিংবা ট্যাবে, হোয়াটস অ্যাপ, জুম অথবা মেসেঞ্জারে চলমান তাঁদের এই সব অশরীরী আড্ডা আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি। কী নিয়ে আড্ডা দেব বুঝে পাইনা। কিছুই তো ঘটছে না জীবনে। বাংলাদেশে থাকা এক বন্ধু খোঁচা দিয়ে বলে, ‘প্রথম বিশ্বের সমস্যা’।
কথাটা ভুল নয়। আমার চাকরি আছে, আমার স্ত্রীর ক্যারিয়ার আছে, আমাদের মাথার উপর ছাদ আছে, এদেশে বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায়, আমাদের চিকিৎসার খরচ যোগায় রাষ্ট্র, আমাদের ছেলেটা স্কুলে যায় রাষ্ট্রের খরচেই। বিচ্ছিরি একটা ঝামেলার ভেতরে পড়ে গিয়েছি কেবল। তবে ঝামেলাটা সাময়িক। কেবল কষ্ট করে কিছুদিন ঘরে বসে থাকা। নাহয় নাইবা গেলাম পার্কে-সিনেমায় কয়েকটা মাস। নাইবা জমলো সংবিধিবদ্ধ সাপ্তাহিক বাঙালি দাওয়াতের মাছ-মাংস-ভাজি-ভর্তার আসর, ভরপেট খেয়ে বিকট গলায় হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-চিত্রার কান পাকড়ে নামিয়ে আনা মাঝবয়সের ঝিমনো বৈঠকে। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দার ভয়টা মাথা চাড়া দিতে চাইলেও নিজেকে আশ্বস্ত করি, বোঝাই যে এখানে সিস্টেম আছে। সিস্টেমটা কাজ করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বেঁচে থাকলে পার পেয়ে যাবো ঠিক ঠিক।
আমার অদৃষ্টবাদী বন্ধুটা বলে, ‘এতোসব চিন্তা বাদ দে। যা আছে কপালে’। সেই বন্ধুটা মনের সুখে বাজার করে, অদৃষ্টবাদী অন্য বন্ধুদের বাড়িতে যায়, ওরাও আসে ওই বন্ধুর বাড়িতে। ওদের ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ঝলক দেয় সিমকো লেইক থেকে সদ্য ধরে আনা রুপোলী রুপোলী মাছের ছবি। আমি বেজায় বিরক্ত হয়ে আমার ভীরু বন্ধুদের ফোন করে বলি, ওই ব্যাটারা তাহলে অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যায় কেন?
প্রথম বিশ্বের এই সুখ সুখ হাহাকারের ভেতর দিয়ে কেটে যায় সারাদিন। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন অন্ধকারে, স্ত্রীর ঘুম না ভাঙ্গিয়ে, বেডসাইড টেবিল থেকে ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে চলে যাই সাত সমুদ্র তের নদীর পারে রেখে আসা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে- আমার নিজের দেশে। একটার পর একটা খবর পড়ি, বন্ধুদের লেখায় চোখ বুলাই। আগে এটা সেটা নিয়ে তর্ক করতাম। এখন চূড়ান্ত স্বার্থপরতার এই তালপুকুরে ডুবে থেকে ভীষণ লজ্জা লাগে কিছু বলতে। নিজের বিপদ তুচ্ছ করে কাজ করে চলা সাহসী বন্ধুদের হাতে আমার বাবা-মা-বোন-ভাগনে-স্বজনদের গছিয়ে দিয়ে আমিও হয়ে উঠি অদৃষ্টবাদী। সোনার কৌটায় আটকে থাকা প্রাণ ভ্রমরাটা কেবল থেকে থেকে ডানা ঝাপটায়। রাত বাড়ে, একটা সময় সেই ছটফটানিকে উপেক্ষা করে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
লেখক: কানাডা প্রবাসী শিক্ষক