Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রতিদিনই কেন ‘মা দিবস’ নয়!


১০ মে ২০২০ ১৮:০৫

আজ মে মাসের ১০ তারিখ। বিশ্ব ‘মা’ দিবস। মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রতি বছর বিশ্বব্যাপি পালিত হয় দিনটি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয় বেশ মর্যাদার সাথে। পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই। ‘মা’ শব্দটি খুব ছোট হলেও এর তাৎপর্য অনেক। আজকের এই দিনে বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।

‘মা’ শব্দটি উচ্চারণ করলে কেন যেন গা শিহরিত হয়। সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণেই হয়তো এটা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে মায়ের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। এ শব্দটির মাঝে লুকিয়ে থাকে অসীম ভালোবাসা আর প্রশান্তি। নেপোলিয়ান বলেছেন ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ নেপোলিয়ানের এ উক্তি থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় শিক্ষিত জাতি গঠনে মায়ের একটা বড় ভূমিকা আছে।

বিজ্ঞাপন

আবার ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ মা বেঁচে থাকতে মায়ের সম্মান ও মর্যাদার মূল্য বোঝা যায় না। যাদের মা নেই কিংবা ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে তারা জানে মা হারানোর ব্যথা মনের মধ্যে কতটুকু পীড়া দেয়। একটি পরিবারে মায়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সন্তান লালন-পালন করা এবং শিশুকে প্রাথমিক আচরণ কিংবা শারীরিক বিকাশে প্রত্যেক মায়ের ভূমিকা নিশ্চই বাবার চেয়ে বেশি।

‘মা’ শব্দটির সাথে কেমন যেন একটা মায়া-মমতা এবং মধু জড়িয়ে আছে। কারণ পরিবারের কারো সাথে বেয়াদবি করলে কিংবা কোন ভুল করলে অন্য কেউ বকা দিলেও কেবল মা আদর করে সন্তানকে ভুল কাজ না করতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। আবার কখনো মা সন্তানের ভুলের জন্য বকা দিলে কিংবা শাসন করার জন্য হাল্কা পিটুনি দিলেও ঘুমানোর সময় গায়ে হাত দিয়ে আদর করেন।

বিজ্ঞাপন

একটি পরিবারে মায়ের ভূমিকা কতটুকু তা মনীষীদের উক্তির দ্বারাই ভালোভাবে প্রমাণিত হয়। যেমন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি পিতা-মাতার সেবা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমে তুমি তোমার মায়ের সেবা করবে’ এমন বক্তব্য তিনবার বলার পরে বাবার সেবা করতে বলেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মায়ের মর্যাদাকে পরিবারের সবার উর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর মানুষের কাজ হবে সব প্রাণীর চেয়ে ভালো। কিন্তু মানুষ এমন কাজ করে যা সমাজে তাদের মর্যাদাকে পশুর চেয়েও নিচে নিয়ে যায়। আর এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য একটি পরিবারে মা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।

দীর্ঘ দশ মাস দশদিন পেটে ধারণ করে মা যখন সন্তান জন্মের জন্য ধাত্রী কিংবা প্রসূতি বিশেষজ্ঞের কাছে যান তখন মায়ের মনে অনেক ভয় অনুভূত হয়। কষ্ট হবে জেনেও মা আশায় বুক বাঁধেন। রাতে ঘুমানোর সময় সন্তান যখন পেটে গুঁতো দেয় তখন মায়ের খুব কষ্ট হয়। সন্তান প্রসবের সময় পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্ট অনুভব করেন মা। সন্তান প্রসবের পর মা যখন ভূমিষ্ঠ শিশুর মুখ দেখেন তখন অতীতের সব ব্যথা-বেদনা ভুলে যান। সন্তানকে কোলে নিয়ে মা যখন দুধ পান করান তখন সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়। মা সন্তানকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য কত কষ্ট করে তা কেবল মায়েরাই বোঝেন। সংসারের সকল আরাম- আয়েশ পরিহার করে শিশুকে ভালোভাবে বেড়ে উঠার জন্য মা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেন।

নিজের খাবার সন্তানকে দিয়ে মা তৃপ্তি অনুভব করেন। বাবা যখন বাজার থেকে মিষ্টি বা অন্যান্য খাবার এনে পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে ভাগ করেন তখন মা তার নিজের ভাগটা সন্তানদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে নিজে না খেয়ে থাকেন। আর তাতেই তিনি আনন্দ পান। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না করলে মা সর্বপ্রথম সন্তানদেরকে খাওয়ান। নিজের খেতে হবে এমন চিন্তা মা কখনো করেন না। সন্তানদেরকে খাওয়াতে পারলেই মায়ের ক্ষুধা দূর হয়। সন্তান যখন স্কুল কিংবা খেলার মাঠ থেকে এসে ‘মা’ বলে ডাক দেয় তখন মায়ের মন তৃপ্ত হয়। আসলে মায়ের মতো আপন পৃথিবীতে নেই।

মা সন্তানের বন্ধু, অভিভাবক, পরিচালক, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মায়ের ঘুম পাড়ানো গান ও গল্প শিশুর ঘুমে সহায়তা করে। মা যেমন ভুলের জন্য বকা দেন, হাল্কা পিটুনি দেন তেমনি পরোক্ষণে তিনিই আবার বুকে নিয়ে আদর করেন। মা আমাদেরকে ছোট থেকেই আদব-কায়দা থেকে শুরু করে সব প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস পরিমাপ করা গেলেও সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কতটুকু তা কোন এককে পরিমাপ করা যায় না। সকালে ব্রাশ করা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সর্বদা মায়ের যে ভুমিকা তা অপরিশোধযোগ্য।

যে মা না হলে আমাদের পৃথিবীতে আসা কল্পনা করা যায় না সে মায়েরা কী আজ ভালো আছেন? তাদের সবাই কী তিনবেলা খাবার পাচ্ছেন? বৃদ্ধ বয়সে সন্তানেরা কী তাদেরকে ঠিকমতো সেবা দিচ্ছেন? উত্তরটা হ্যাঁ ও না দুটিই হতে পারে।

দেশে আজ শত মা নিজ সন্তান দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন। সন্তানের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যে মা দীর্ঘদিন পেটের মধ্যে সন্তানকে রেখেছেন এবং ছোট থেকে বড় করে তুলেছেন সে মায়েরা আজ সন্তানের কাছে ভালো ব্যবহার পান না। সন্তানের বিরাট অট্টালিকা থাকলেও মায়ের জন্য একটি কুঁড়ে ঘরেরও ব্যবস্থা করেন না। সন্তান তান বউ নিয়ে তিন বেলা পোলাও মাংস দিয়ে খাবার খেলেও মায়ের জন্য সাদা ভাতের ব্যবস্থাও হয় না। কিন্তু কেন? এর নাম কী মা-সন্তান সম্পর্ক?

আজকাল পত্রিকার পাতা খুললে শত মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কোন মা চিকিৎসার অভাবে, কোন মা তীব্র শীতে গরম কাপড়ের অভাবে আবার কেউ খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছেন। যে মা তার সন্তানকে খেয়ে-না খেয়ে মানুষ করেছেন। নিজের ভাগের খাবারটুকু সন্তানকে দিয়েছেন। সে মা আজ সন্তান বেঁচে থাকতে এমন অবহেলায় মারা যাবে তা মেনে নেয়া যায় না। পরিবারে ছেলে-মেয়ে ও বউয়ের জন্য খাবার ও কাপড় কিনতে যে টাকা ব্যয় করা হয় মায়ের ক্ষেত্রে করা হয় তার উল্টো। অথচ কোটি টাকা দিয়েও মায়ের ঋণ শোধ করা যাবে না। সন্তানের গায়ের চামড়া দিয়ে মায়ের জুতো বানালেও সন্তান লালন পালনের ঋণ শোধ হবে না এমন ঘটনা জানা।

গরীব-ধনী সকলের মা তার সন্তানকে ভালোবাসেন। এ ভালোবাসা কেমন তার একটা ঘটনা না বললে স্পষ্ট হবে না- গ্রামের এক মা সংসারে ভালো খাবার বা পরার মতো তেমন ভালো কাপড় জোটাতে পারতেন না। তার তিন ছেলে এবং তিন মেয়ে। ছয়টা সন্তানকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবেন বলে মনে মনে ইচ্ছা করেছেন। গ্রামের অনেকেই তাকে দাদী বলে। যা হোক সন্তানদেরকে তিনি স্কুলে ভর্তি করালেন। অভাবের সংসারে খাতা কলম কেনার মতো টাকা থাকে না। মুরগির ডিম বিক্রি করা টাকা দিয়ে তিনি সন্তানদের খাতা কলম কিনে দিতেন। তার স্বামী অন্যের জমিতে কাজ করতেন দিনমজুর হিসেবে। যে টাকা পেতেন তা দিয়ে সংসার চলতো না। তাদের কোন জমিও ছিল না দিয়ে সংসারের খরচ চলবে। তবে তারা বাড়িতে ছাগল-গরু পালন করতেন। তার ছেলেরা স্কুল থেকে ফিরে গরু-ছাগল নিয়ে মাঠে যেত। গ্রীষ্ম কিংবা অন্যান্য ছুটিতে ছেলেরা অন্যের কাজ করত।

আবার রাতে ঠিকই পরিবারের সব ভাইবোন একই বাতিতে লেখাপড়া করত। এভাবেই কেটেছে দিনের পর দিন। সে মায়ের তিন সন্তান এখন স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকুরি করেন, দু’জন উচ্চমাধ্যমিকে এবং মাধ্যমিকে লেখাপড়া করছে। তার সন্তানরা লেখাপড়ায় যেমন ভালো আচার-ব্যবহারও ভালো। তাকে রত্নগর্ভা বলা যায়।

আগের চেয়ে তাদের পরিবারের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো হয়েছে। তাদের পরিবার আরো সুখের হবে। নিশ্চয় সে মা আমাদের জন্য শিক্ষনীয়।

আজকের এই শুভ দিনে নিজের মাকে নিয়ে কিছু না লিখলে তার প্রতি অসম্মান হয়ে যাবে। আমার ‘মা’ একজন সরকারী চাকুরিজীবী। গ্রামের অন্য মায়ের সাথে তার পার্থক্য থাকলেও তিনি গর্ভধারিণী। গ্রামের মধ্যে বেড়ে উঠায় আমার জীবনের কোন লক্ষ্য ছিল না। খেলা দেখার সময় আকরাম খান, ভোটের সময় চেয়ারম্যান কিংবা এমপি হওয়ার ইচ্ছা জাগতো। অর্থাৎ লক্ষ্যহীন জীবন। স্কুলে যাওয়া শুরু হয়েছে কখন তা মনে নেই। তবে স্কুলে যাব না বলে বাবার পিটুনি আর বই ছেড়ার ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে।

প্রথম দিকে স্কুলে যাওয়ার সময় মা আমাকে বাবার পিটুনি থেকে বাঁচিয়েছেন এটাও মনে আছে। মা চাকুরি করায় সময়মতো দুপুরের খাবার খাওয়া হতো না। সেই সুযোগে আমি খাওয়া ও গোসল বাদ দিয়ে শুধু খেলায় মেতে থাকতাম। মাঝে মাঝে মা আমাকে খাওয়া আর গোসলের জন্য হাল্কা পিটুনি দিতেন। একদিন গোসলের সময় আমার বিরক্তি দেখে মা খুব করে মেরে গোসল করালেন। রাগ করে না খেয়ে বাড়ি পালিয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। আমার খাওয়া হয়নি বলে সেদিন মা খাননি।

আমাকে কাছে ডেকে ব্যথা পাওয়ার যায়গায় হাত দিয়ে মা কেঁদে ফেলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোর জন্য আমি এখনো খাইনি। ছোট থেকেই মা আমাকে স্বপ্ন দেখান বড় হওয়ার এবং বাবা কোনদিন শহরে গেলে আমাদের জন্য বিভিন্ন রকম খাবার নিয়ে আসতেন। আমরা খেয়ে নিলেও মা তার ভাগ রেখে দিতেন এবং পরের দিন স্কুলে যাওয়ার আগে আমাকে ও ছোট বোনকে পুরোটা দিয়ে দিতেন। মা কখনো অফিসের কাজে শহরে গেলে হাল্কা নাস্তা পেতেন।

কিন্তু তিনি সেটা না খেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। আজকের এই দিনে ‘মা’ তোমার কল্যাণ কামনা করছি। মা তুমি সুখে থেকো। আমি যেন কখনো তোমার অবাধ্য না থাকি আল্লাহর কাছে তাই প্রার্থনা করছি।

মা দিবসে আমাদের মায়েদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। মা’ই পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মানের দাবিদার। বাবা বেঁচে না থাকলেও সন্তানের জন্য খুব একটা কষ্ট হয় না। কিন্তু মা হারিয়ে গেলে সে ঘাটতি কখনো পূরণ হয় না। মায়ের আদর এবং স্নেহ পেয়ে পিতার ভালোবাসার কথা মনে থাকে না। সামান্য কষ্ট পেলে মা যখন সন্তানের নাম ধরে ডাকেন তখন মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করা যায়। আবার বড় ধরনের বিপদেও মা যখন কাছে নিয়ে উৎসাহ দেন তখন সকল বাধা ও জীর্ণতা সন্তানের কাছে পরাজিত হয়।

আজকের এ দিনে আমরা শপথ নিবো, শুধু মা দিবসেই নয়, প্রতিটি দিনে, প্রতিটি ক্ষণে তিনি যেন আমাদের সেবা পরিচর্যা ও ভালোবাসা পান। শিশু থেকে বিবাহ পরবর্তী জীবনে মা যেন সন্তানের চিকিৎসা-সেবার অভাবে অবহেলার পাত্র না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখব। ছোটবেলায় তারা আমাদের জন্য যে কষ্ট করেছেন তার জন্য আমরা তাকে সর্বদা মান্য করব। সর্বোপরি পরম করুণাময় আমাদের মায়েদেরকে সুস্থ রাখেন তার জন্য দোয়া করবো। গাঢ় হোক মায়ের সাথে ভালোবাসার বন্ধন আর আর খুশিতে থাকুক আমাদের মায়েরা- এটাই হোক আজকের প্রত্যাশা। প্রতিদিনই হোক মা দিবস।

 

লেখক: কলাম লেখক

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর