করোনা সংকট কি শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায়?
৫ মে ২০২০ ১৯:২৬ | আপডেট: ৫ মে ২০২০ ২১:৫৮
এক অদৃশ্য শক্তি করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র মহামারী অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এও এক ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি, যে যেভাবে পারছে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। কতদিনের এই সংগ্রাম, কারো কাছেই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। করোনাভাইরাস ইস্যুতে ইতোমধ্যে পরাশক্তির বিতর্ক শুরু হয়েছে, বাকযুদ্ধ চলছে, এর দায় কার? আর কীভাবেই হবে এর সমাধান?
বাংলাদেশেও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। তার একটা যৌক্তিক কারণও আছে বটে। স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ, যে রাষ্ট্রটি তার জিডিপির ৯.০৩ শতাংশ ব্যয় করে জনস্বাস্থ্য খাতে। ৫.৫৫ শতাংশ ব্যয় নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নেপাল। ভারতের চেয়ে শ্রীলংকার ব্যয় বেশি ৩.৮১ শতাংশ। সেখানে ভারতের ব্যয় ৩.৫৩ শতাংশ। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বাংলাদেশের। জিডিপির মাত্র ২.২৭ শতাংশ ব্যয় নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত চলছে। আর ২.৯০ শতাংশ আছে পাকিস্তানের।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর লক্ষ-কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। মন্ত্রী, এমপি মহোদয়রা গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে বেড়ান গত বছর এত লক্ষ-কোটি টাকার বাজেট ছিল। এ বছর আমরা এত লক্ষ-কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। এই হলো আমাদের উন্নয়নের রেখাচিত্র। গত ১২ বছরে যতোটা উন্নয়নের আওয়াজ হয়েছে ততোটা গুণগত পরিবর্তন আসেনি। তার বড় প্রমাণ বাস্তব
চিত্রটা বর্তমানে নাগরিকরা উপলব্ধি করেছেন। কিছুদিন আগেও ডেঙ্গু মশার সংক্রমণে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই প্রমাণ দেখা গেল।
নাগরিকদের যে কয়টি মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের রক্ষা করার দায় ও দ্বায়িত্ব তার মধ্যে অন্যতম খাদ্য ও চিকিৎসা। খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, অতীতেও ছিল। চিকিৎসার অভাবে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, মহামারি দেখা হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা নিয়ে নানানভাবে দোষ দেওয়া হচ্ছে ডাক্তার ও নার্সদের। দোষটা আসলে রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের ব্যবস্থাপনার।
গত ২৭ এপ্রিল বিবিসি বাংলার অনলাইন এডিশনে লিড নিউজের শিরোনাম ছিল ‘সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে এত বিভ্রান্তি কেন?’। এই শিরোনাম থেকেই যথেষ্ট বোঝা যায় কতোটা অব্যবস্থাপনায় চলছে দেশ।
করোনার এমন পরিস্থিতিতে মনে প্রশ্ন জাগে, এক ও অদ্বিতীয় এই বিশ্বমণ্ডলের যিনি একমাত্র মালিক তিনি কি তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন? নাকি এটা নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের দায়িত্ববোধ হারিয়ে যাওয়ার বহিঃপ্রকাশ? নাকি সাধারণ নাগরিকরা নিজের স্বার্থে জীবন আর জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকার রাজনীতির সহনশীলতা হারিয়েছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। উত্তর খোঁজার দ্বায়িত্বটা আমারও না। দ্বায়িত্বটা আসলে যাদের আশা করি তারা খুঁজবেন। রাষ্ট্রে যে কোন সংকট আসুক, সংকট ঘনীভূত হবার পূর্বেই মোকাবেলা করতে সমাধানের লক্ষ্য রাজনৈতিক ঐক্যমতের বিকল্প নেই। একটি সংকট জন্ম নেবার পর থেকে সংকট ঘনীভূত হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকরা একে প্রধান দুইদলের মতাদর্শগত সংঘাত হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। যা এখন খুব জরুরি। সরকার আর বিরোধীদলের মতাদর্শ সংঘাতের মধ্যে যৌক্তিক কথাটা তুলে ধরতে পারেন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দরা। নিপীড়নমূলক সমাজের মধ্যেও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দকেই মান-অভিমান ভুলে এই সংকটে এগিয়ে আসতে হবে। গোটা দেশে সামগ্রিক সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে জনগণের কোন অধিকার এখন পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে কতটুকু মনযোগী? জনগণকে ভুলে যাওয়ার পরিণতি কখনই ভালো হয় না, অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে।
যে কোনো সংকটে সাধারণ নাগরিকদের দায় কম। নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে দুটো উদাহরণ যথেষ্ট। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রকাশ হবার পর লকডাউন ঘোষণা না করে ছুটির ঘোষণা করা হলো। মানুষ দল বেঁধে ঈদের ছুটির মতো গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলেন। কয়েকদিন পর গার্মেন্ট শ্রমিকরা খবর পেয়েছেন বেতন দেওয়া হবে, গার্মন্টেস চালু হচ্ছে। শ্রমিক ভাই বোনেরা পায়ে হেঁটে, দল বেঁধে, ফেরিতে করে নদী পার হয়ে রাজধানীতে আসলেন। আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গ্রামের বাড়ীতে গেলেন। এই দায় কার? সাধারণ নাগরিকদের নাকি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার?
সাধারণ নাগরিক উদ্বুদ্ধ হন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে। প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীর প্রতিযোগিতার মধ্যে নাগরিকরা তাদের কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা যখন হারিয়ে যায়, তখন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হয় অস্থিরতা। সে সময় প্রয়োজন হয় নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের এগিয়ে আসার। তখন যদি তারা এগিয়ে না আসেন তাহলে রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বটা কে পালন করবে?
আমাদের সমাজে যে সকল মানুষ নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা সরকারের অনুগত। আর তা নাহলে রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিনত হয়েছেন। ব্যবসায়িক সমাজ, সাংবাদিক সমাজ, শিক্ষক সমাজ, চিকিৎসক সমাজ, আইনজীবীসহ প্রায় সর্বস্তরেই এই পরিস্থিতি। নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দরা রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসবেন না, হয়তো আসতেও চান না। তারা রাষ্ট্রের
অসংলগ্নগুলো সাদা চোখে রাষ্ট্রনীতিকদের কাছে তুলে ধরবেন।
দেশের জাতীয় সংকটে বিশেষ করে আজকের সংকটে ক্ষমতাশীন নেতৃবৃন্দ ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে বস্তুনিষ্ঠভাবে নাগরিকদের সমস্যা তুলে ধরতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেই এই সমস্যার অন্তনির্হীত কারণ অনেকাংশে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। সাধারণ নাগরিকরা অসহায়। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করুন। তবেই সাধারণ নাগরিক আশার আলো দেখতে পাবে। সময় কিন্তু খুব দ্রুত বয়ে যাচ্ছে!
লেখক: সহ-সভাপতি, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)