করোনা মোকাবেলার বাস্তবতায় সমন্বিত প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা
৪ মে ২০২০ ১৯:৪৯
রোগ এবং নিরাময়। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষয়ে এ ধারণাটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ঠিক মনে হলেও মূলত রোগের কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে রোগের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ যা সময়ের সাথে গড়ে ওঠে ঐ জনগোষ্ঠীর সমাজ কাঠামো, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে।
দেখা যায় যে, রোগের কারণ এবং প্রতিকার বিষয়ে নগর এবং গ্রাম এমনকি শ্রেণীভেদেও ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস এবং চর্চা বিদ্যমান। ফলে একক নীতিমালার ভিত্তিতে রোগ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জন বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই এ ক্ষেত্রে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো ও এ প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও চর্চাকে বিবেচনায় নিয়ে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গৃহীত একটি সমন্বিত প্রস্তুতি রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বের জন্যই এক নতুন অভিজ্ঞতা। ফলে অধিকাংশ দেশই তা মোকাবেলায় হিমশিম খেয়েছে এবং বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কিছুটা দেরিতে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার বদৌলতে আমরা কিন্তু বেশ আগে থেকেই এ রোগের ধরণ, প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে অবগত হয়েছি এবং প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়ও পেয়েছি। কিন্তু ৮মার্চে যখন বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলো তখন থেকেই শুনে আসছি, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রস্তুত আছে। অথচ দেখা গেল, কোভিড-১৯ এর মত সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ মোকাবেলার যথেষ্ট সামর্থ্য আমাদের নেই। ফলশ্রুতিতে সেই প্রস্ততি এবং সামর্থ আমরা যখন অর্জন করার চেষ্টা করতে থাকলাম ততদিনে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে আমাদের কল্পনার চেয়ে বেশি।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী যে পরামর্শটি দেওয়া হয়েছে তা হলো- “সামাজিক দূরত্ব” নিশ্চিত করা এবং পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন থাকা বিশেষত হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরিধান করা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় শিষ্টাচার বজায় রাখা।
“সামাজিক দূরত্ব” এমনই একটি নতুন ব্যাপার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যে রোগের প্রতিকারের জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের যে সীমাবদ্ধতা তার পাশাপাশি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জনগণকে “সামাজিক দূরত্ব” বিষয়টি বোঝানো এবং মানুষকে ঘরে রাখা আর জরুরী প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলেও পারস্পারিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। কারণ এ ক্ষেত্রে শহর-গ্রাম-ধনী-দরিদ্র এই সকল ভিন্ন প্রেক্ষাপট ভিন্ন বাস্তবতা বহন করে।
তাছাড়া কোভিড-১৯’কে রোগ হিসেবে দেখে তার চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে যতটা গুরুত্ব এবং হা-হুতাশ লক্ষ্য করা গেছে ততটা গুরুত্ব কিন্তু রোগটি যাতে না ছড়ায় সেই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হতে পারে সে বিষয়ে যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে একদিকে নাগরিকদের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন এই সংক্রামক মহামারী বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতেই বেশ বেগ পেতে হয়েছে আর অন্যদিকে রোগের বিস্তার রোধে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম থেকে শুরু করে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়েও আমরা ঘটতে দেখেছি নানাবিধ অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
একদিকে প্রবাসীদের আগমনে যথেষ্ট পরীক্ষা ও সতর্কতা অবলম্বন না করার ফলে প্রবাসীরা নিজ বাড়িতে ফিরে অসতর্ক চলাফেরা করেছেন এবং পরিবার-প্রতিবেশীদের আক্রান্ত করেছেন আবার অন্যদিকে বেশ কিছু প্রবাসী নানাভাবে সামাজিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে।
জনগণকে ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতে গণপরিবহণ বন্ধ না করেই যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল তার ফলে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিল মানুষের মোবিলিটি নিয়ন্ত্রণ করা সেই ব্যাপারটিই ঝুঁকির মুখে পড়ে যায় এবং একাধিকবার গার্মেন্টস বন্ধ ও খুলে দেওয়া বিষয়ক সিদ্ধান্তহীনতার কারনে পরবর্তিতেও সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে।
সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গার্মেন্টস ও কারখানা খুলে দেওয়া, ইফতারি বিক্রির জন্য স্বনামধন্য রেস্টুরেন্টগুলো খুলে দেওয়া, শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হঠকারী হতে পারে।
পাশাপাশি এ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে যে সুযোগসন্ধানী মনোভাবটি রয়েছে তার ফলশ্রুতিতে কেউ ত্রাণের সামগ্রী চুরি করেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন এমনকি নারী ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে সর্বদা শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, রোগের প্রতিষেধক কিংবা প্রতিরোধের উপায় বিষয়ে নানাবিধ গুজব তুলে বাজার থেকে থানকুনি পাতা উধাও করে দিচ্ছে, আদা ৪০০টাকা কেজি আর লেবু ৮০টাকা হালিতে বিক্রি করছে, কেউবা পিপিই পরিধান করে করোনা রোগী অনুসন্ধানের কথা বলে বাড়িতে ডাকাতি করছে।
একদিকে করোনা রোগী সন্দেহে হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে চাইছে না আবার অন্যদিকে রোগী করোনা পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও তথ্য গোপন করায় আক্রান্ত করছেন স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে।
একদিকে যথেষ্ট ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে চিকিৎসক করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন আবার অন্যদিকে চিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসককে পরিবারসহ ঘরছাড়া করার চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনা চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতাল কিংবা করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বিক্ষোভও করছে।
বাঙালির অতি কৌতূহলী আচরণের কারণে বিদেশফেরত প্রবাসী বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দী থাকলেও তার বাড়ির সামনে ভীড় করছে কিংবা করোনা চিহ্নিত হওয়ায় লকডাউনকৃত বাড়ি দেখার জন্য তার সামনে জটলা করেছে।
জনগণের ঘরে থাকা নিশ্চিত করার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হলেও গলিতে আড্ডা দেওয়াকে আমরা কৃতিত্ব মনে করি। করোনায় মৃত তো অবশ্যই এমনকি করোনা সন্দেহে মৃত ব্যক্তির জানাজা কিংবা সৎকারের জন্য কাউকে পাওয়া না গেলেও একই সময়ে ধর্মীয় বক্তার জানাজায় লাখো মানুষের ভীড় হয়।
হাত ধোয়া কর্মসূচী উদ্বোধন, ত্রাণ বিতরণ কিংবা ধান কাটা কার্যক্রমে দলবদ্ধ অংশগ্রহণ করে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির যে মানসিকতা ও আচরণ তা কীভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
একেক দেশের বাস্তবতা একেক রকম। ফলে সকল দেশের সংক্রমণ ও তা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য ও ব্যর্থতার মাত্রা একই হবে না। বাংলাদেশের ঘনবসতি, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের সক্ষমতার অপর্যাপ্ততা এবং সর্বপরি দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংকৃতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা যে আচরণ তা রোগ নিয়ন্ত্রণের সাফল্য এবং ব্যর্থতার এক উল্লেখযোগ্য নির্ধারক।
তাই রোগকে এককভাবে কেবল চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষয় হিসেবে না দেখে বরং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার নিরিখে গৃহীত সমন্বিত প্রস্তুতি কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে অধিকতর যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়