Wednesday 01 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাসংকট: আক্রমণাত্মক না রক্ষণাত্মক খেলবো?


১ মে ২০২০ ১৮:৩৭ | আপডেট: ১ মে ২০২০ ১৯:৩৮

কোভিড-১৯ মহাসংকটে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সারাবিশ্বের মৃত্যুর হার কি দেখেছেন? দাম্ভিকতায় আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়েছিল যুক্তরাজ্য, শর্ত সাপেক্ষে কিছুটা শিথিলতা করে সুইডেনের মতো হার্ড ইমিউনিটির ফর্মূলাতে গিয়েছিল বেশ আগে। কিন্তু পারে নি, বাধ্য হয়েই দিতে হয়েছে লকডাউন। ফলাফল অনেকটা দিন পার হয়েও বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশে এখনও অচলাবস্থা।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে গবেষকরা কাজ করছে। কিন্তু লম্বা সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনস্বাস্থ্য নীতি মেনে নিয়ে যারা একটু কঠিন অবস্থান নিয়েছে তারাই টিকে গেছে। জনস্বাস্থবিদের পেসক্রিপশন ছাড়া দেশের বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। কোন ফর্মুলা দিয়ে কি বুঝাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ব্রাজিল, ইকুয়েডর, রাশিয়ার দিকেও চোখ রাখি। মনে হচ্ছে নতুন করে লাশের মিছিলে লাতিন আমেরিকার দিকে এগোচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

লকডাউন, কারফিউ, জরিমানা, জোর করে ঘরে থাকতে বাধ্য করা- এসবে সফলতা শতভাগ; আর সেটা প্রমাণিত তাইওয়ান, নেপাল, ভুটান, অস্ট্রিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এসব দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতির সুযোগের মাঝে গায়ে আঁচড় লাগবে না ধরণের দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিল। প্রস্তুতির কিছুই নেই আমাদের, এই যাত্রায় চিকিৎসা ছিলো একটাই; সেটা কঠিন লকডাউন। গড়িমসি করতে করতে অবশেষে তা করা হয়। কিন্তু ফলাফল উল্লেখ করার মতো না।

অতীত ব্যর্থতা ভুলে প্রতিটি দিন লকডাউনের সফলতার আশাতেও যে ব্যর্থতার চিত্র ভেসেছে সেটাও মোকাবিলা করা যেতো। আমরা সেটা করিনি কারণ বাঙালি অতিথিপরায়ণ, প্রশাসনও কঠিন হতে পারে না, তারাও অতিথিপরায়ণ। জানি না কার এবং কিসের লজ্জায়!

বিজ্ঞাপন

জাতি হিসাবে আমরা এমন যে, নিজে বাঁচতে নিষ্ঠুর হতে পারি। যে স্বাস্থ্য কর্মী চিকিৎসা সেবা দিয়ে বাড়ী ফিরেছেন তাকে কোয়ারেনটাইনে রাখার নামে আমরা তাকে রেখেছি জঙ্গলের মধ্যে পুকুরপাড়ে পাতা দিয়ে বানানো ঘরে। চিকিৎসক করোনা চিকিৎসা দিয়ে ঘরে ফিরলে তার ঘরে ঢিল ছুড়ে দলবেঁধে এলাকাছাড়া করতে ব্যস্ত হই। করোনায় সেবাদানকারী কর্তব্যরত চিকিৎসক ভাড়াটিয়াকে বাসা ছেড়ে দিতে বলি। পক্ষান্তরে ইতালি থেকে দেশে ফেরা লোকগুলোকে মিষ্টির দোকানে অবাধ ঘোরাঘুরির সুযোগ দেই।

বিদেশ ফেরত কিছু মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে থাকাটা নিশ্চিত অথবা ফিরতে নিরুৎসাহিত করতে পারলে জাতিকে বাঁচানো যেত। শুরুতে শতভাগ লকডাউন, ঘরে থাকতে বাধ্য করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে আমরা এখন আমাদের অর্থনৈতিক চাকা ধীরে ধীরে চালু করতে পারতাম।

আমার মনে হয়েছে, করোনায় প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কেমন যেন একটা ডুয়েল গেম খেলেছি। যতবার হাত ধুতে বলেছি, ঠিক ততবার ঘরে থাকতে বলিনি। আবার ঘরে থাকতে বলে কলকারখানা খুলে দিয়েছি, সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে গিয়ে সামাজিক বন্ধনে শপথ নিয়েছি। দলেবলে একসাথে হয়ে আমরা বলছি- আসুন করোনা মোকাবেলা করি। রেড জোনের বাজারগুলোও নিয়ন্ত্রণে আসে নাই।

করোনার চিকিৎসার ব্যাপারটা বেশীরভাগ মানুষের কাছে এমনভাবে দৃশ্যায়ন হলো যে, হাত ধুয়ে মাস্ক পরলেই সব ঠিক। কিন্তু আমরা বোঝাতে পারি নাই যে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেলে লকডাউন, কঠিন লকডাউন ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই।

শর্ত সাপেক্ষে কলকারখানা, গার্মেন্টস খোলা হাস্যকর। কারণ এদেশের মানুষ এখনও শর্ত পালনে নিজেদের তৈরি করতে পারেনি, এগুলো জোর করেই অভ্যস্ত করতে হয়। অদ্ভুত মিলন মেলা, যেন সহমরণ। পরিবহন খুলে দিলে আর কিছুই লাগে না, প্রতি বাসে বাসে আমরা করোনা নিয়ে খুব দ্রুত বিস্তার করতে পারবো।

হোটেল, রেস্টুরেন্ট খুলে ইফতার বিক্রি করতে দেওয়া এক আশ্চর্য সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিকভাবে রোজা রেখে ঘরে খাওয়া উত্তম। করোনাকালে হতাশ হতে হয় এরকম সিদ্ধান্তে। নীতি নির্ধারকরা কিন্তু বের হচ্ছেন না, ওনারা বলে যাচ্ছেন- ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন।

হয়তো বিশেষ প্রয়োজনে তাদের ইফতারের প্রস্তুতির জন্য এভাবে রেস্টুরেন্ট খোলাটাও হঠকারী সিদ্ধান্ত। হয়তো বেতন দেওয়া হবে না, কারখানায় না গেলে চাকরি থাকবে না- এমন ভয় সাধারণ মানুষের।

সাধারণ মানুষের মাথায় কেবল ‘মাস্ক আর সাবান পানি, করোনায় মুক্তি’। এসব আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন। কিন্তু লকডাউন, জরিমানা, লকডাউনে বের হলে কঠিন শাস্তি- এমন কঠিন থিওরি কেউ বলেনি।

এদিকে যে যাই বলুক না কেন, দেশে করোনা টেস্ট সোনার হরিণ, তারপর সেটার উপর কন্টাক্ট ট্রেস, হাস্যকর। চিকিৎসা পাওয়া দুষ্প্রাপ্য। করোনা পজিটিভ অথবা নেগেটিভ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেই একজন রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে এই হাসপাতাল সেই হাসপাতাল দৌড়াতে হচ্ছে।

করোনার ভয়াবহতার সর্বোচ্চ সময়কাল নিকটে, হাজার হাজার বেডের সাময়িক হাসপাতাল হচ্ছে, ভেন্টিলেটর সুবিধা কতোটুকু হতে পারে আমি চিন্তিত, হয়তো সৎকারের জায়গাটাও খুঁজে রাখা হচ্ছে।

এরপর আসছে ডেঙ্গু, সেটার কি ব্যবস্থা জানি না। সে বিষয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। ডেঙ্গু নিয়ে গতবছর আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আর নাই বা বললাম। হার্ড ইমিউনিটি করতে গিয়ে ব্রিটেনের থেকেও অনেক ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে আমাদের।

রাষ্ট্রের কাছে আবেদন, দয়া করে ১৫টা দিন জরুরী অবস্থা ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে শান্তি দিন। চিকিৎসক, প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সব ভলান্টিয়ার যোদ্ধারা মাঠে থাকবে। শুধু জনগণ ঘরে থাকবে। ৩০০ জনপ্রতিনিধি তারা দয়া করে মাঠে নামুন, আপনার কাউন্সিলর, ওয়ার্ড পর্যায়ের সকল সামাজিক শক্তির সাথে নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়ে যার যার এলাকায় সাহায্য সহযোগিতার সাথে জনগণকে ঘরে রাখুন। আমরা বেঁচে যাব। করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে আমার সন্তানকে নিয়ে আবারো গান গাইতে চাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

আমাদের রক্ষণাত্মক খেলতে হবে। খেলতে না যাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি ভালো ছিল।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; গবেষণা সহকারী, বিএসএমএমইউ

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

ফিরে দেখা ২০২৪ / ছবিতে বছর ভ্রমণ
১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪৫

আরো

সম্পর্কিত খবর