চিকিৎসকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করুন
২৯ এপ্রিল ২০২০ ১৫:০৯
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রধান সেনাপতি হিসাবে কাজ করছে চিকিৎসকরা। তাদের নিরলস নিষ্ঠা আর ত্যাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বাড়ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা আলাদা সুযোগ সুবিধা পাওয়া তো দূরের কথা নিজেদের নির্ধারিত বেতনও পাচ্ছেন না। যা ওই চিকিৎসকদের মাঝে হতাশা তৈরি করছে। তাই সরকারের উচিত এখনই চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে চিকিৎসা সেবা দিতে আগ্রহী করে তোলা।
দেশে এখন পর্যন্ত ৫০০ জনেরও বেশি চিকিৎসাকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তা দেখে দমে যাননি অন্য হাজারো চিকিৎসাকর্মী। মারা গেছেন একজন চিকিৎসক ও একাধিক স্বাস্থ্যসেবাকর্মী। এসব দেখেও অন্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজ করে চলছেন নিরলস। নিজেরা সংক্রমিত হওয়ার ভয়, পরিবার-পরিজনের পিছুটান উপেক্ষা করেই চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত সবাই কাজ করে চলেছেন আক্রান্ত বা আক্রান্ত সন্দেহজনক রোগীদের সেবায়।
শুরুতে চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ নিয়ে সংশয় ছিল। সেই সংশয় কেটেছে বটে, তবে পুরোটা কাটেনি। বরং যা আছে তাই নিয়েই করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে মনোবল শক্ত করে লড়াই করছেন তারা। রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যন্ত সব পর্যায়েই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষের সেবায় কাজ করছেন চিকিৎসাকর্মীরা।
এগিয়ে এসেছেন দেশের হোমিওপ্যাথিক ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরাও। সরকারিভাবে তাদেরও সক্রিয় করা হয়েছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। বিশেষ করে যারা যেখানেই মানুষের চিকিৎসাসেবায় জড়িত ছিলেন কেউ যেন ঘরে বসে না থেকে নিজ নিজ দক্ষতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হন সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সরকারি-বেসরকারি প্রায় দেড় লাখ চিকিৎসাকর্মী এই মুহূর্তে যুক্ত আছেন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সারাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা করোনাভাইরাস প্রতিরোধী সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সারাদেশে সরকারি প্রায় এক লাখ চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি নিয়োজিত আছেন।
এটি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে মাঠ পর্যায়ের তথ্য পাওয়া গেলে। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে অ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ও আয়ুর্বেদিক মিলিয়ে আরও প্রায় ৫০ হাজারের মতো চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করে করছেন, যারা কমবেশি অবদান রাখছেন করোনাভাইরাসজনিত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায়।
জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিয়মিত বেতন পেলেও পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া পড়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়া ৩৯তম বিসিএসের চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা বেশি।
বেতন বকেয়া আছে, এমন ৬০০ চিকিৎসকের তালিকা গণমাধ্যমের কাছে আছে। তবে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারদের সংগঠন হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, এই সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ এম সেলিম রেজা বলেছেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চিকিৎসকেরা সম্মুখসারির যোদ্ধা। এই সময়েও চিকিৎসকদের বেতন হচ্ছে না, এটি অমানবিক ও দুঃখজনক। সবার পরিবার আছে, খরচ আছে। মন্ত্রণালয়ের উচিত, দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাতজন চিকিৎসকের দু–তিন মাসের বেতন বকেয়া। ৩৯ বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের এক থেকে তিন মাস বেতন বকেয়া। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১২ জন চিকিৎসকের দুই–তিন মাসের বেতন বকেয়া।
ভুক্তভোগী চিকিৎসকরা গণমাধ্যমকে জানান, কেন বেতন বকেয়া পড়েছে, তা চিকিৎসকদের অনেকেই স্পষ্টভাবে জানেন না। বেতন না পেলেও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ তাঁদের আশ্বস্ত করেছে, কিছুদিনের মধ্যে এ সমস্যা কেটে যাবে।
দুই থেকে তিন মাস বেতন বকেয়া রয়েছে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১০ জন, কুমিল্লার চান্দিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১৯, রাজশাহী গোদাগাড়ীর ১৪, জামালপুর সদরের ৫, কুমিল্লার দাউদকান্দির ৮, নরসিংদীর রায়পুরার ৫ এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ৫ জন চিকিৎসকের।
৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ৪ হাজার ১৬১ জন চিকিৎসক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নিয়োগ পান। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ১৩৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন তাদের কেউ আক্রান্ত হলে গ্রেড ভেদে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দেয়া হবে। যদি সরকারি কোনো কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাহলে এর পাঁচগুণ আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এই আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এজন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে আশা করি সেটা কার্যকর হবে।
এছাড়া গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের টাকার কোনো অভাব নেই। আমি আপনাদের বলছি টাকা থাকার একটা বেঞ্চমার্ক আছে। সেই বেঞ্চমার্কের ওপরে আমাদের এখন ৯২ হাজার কোটি টাকা বেশি আছে। এটা তো লুকোচুরি করার কোনো বিষয় না।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এতো টাকা থাকতেও কেন চিকিৎসকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না? বেতন পরিশোধের ক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা কোথায়?
এসব প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দিতে পারবেন। আমি স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসাবে সরকারকে অনুরোধ করব- এই করোনা যোদ্ধা চিকিৎসকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করুন। তাদের নিরাপত্তা জোরদার করুন। কারণ তারা বর্তমানে সময়ের প্রথম সারির যোদ্ধা। তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করুন। কারণ চিকিৎসকরা এখন প্রধান অস্ত্র। তাদেরকে এই সংকটকালীন মুহূর্তে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। তা নাহলে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।
লেখক: সংবাদকর্মী