Monday 21 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খুলনায় বেপরোয়া অপরাধীচক্র, ৯ মাসে ১৯ খুন

রেজাউল ইসলাম তুরান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৫ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৪৫ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৫১

খুলনায় বেপরোয়া অপরাধীচক্র। খুনের শিকার তিনজনের ছবি নিয়ে সারাবাংলার কোলাজ

খুলনা: খুলনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। প্রায়ই ঘটছে হত্যা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো নানা ঘটনা। গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর গত ৯ মাসে জেলায় ১৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও, নিয়মিত ঘটে চলেছে সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনা। এতে আতঙ্কে রয়েছে জনগণ। তবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে।

পুলিশ বলছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সারাদেশের মতো খুলনায়ও পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসী ও মাদক বিক্রেতারা এলাকায় ফিরে আসে। এসেই তারা প্রভাব বিস্তারের জন্য একে অন্যের ওপর হামলা চালাতে থাকে। আবার অনেকে জেল থেকে বেরিয়ে আগের তৎপরতায় জড়ায়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সেইসঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনাও।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, আগে থেকেই খুলনার অপরাধ জগতে গ্রেনেড বাবু, আশিক ও নূর আজিম নামের তিনটি গ্রুপের বেশি তৎপরতা ছিল। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি নূর আজিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ৪ এপ্রিল পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছে যৌথবাহিনী। তাকে না পাওয়া গেলেও যৌথবাহিনী নগদ টাকা, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নগরীতে ১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মামলা দায়ের হয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে গতবছরের আগস্টে দু’টি, সেপ্টেম্বরে একটি, অক্টোবরে দু’টি, নভেম্বরে চারটি, ডিসেম্বরে ছয়টি, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দু’টি, ফেব্রুয়ারিতে একটি ও মার্চে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

৮ এপ্রিল সকালে সন্ত্রাসী হামলায় আহত পলাশ (১৮) নামের এক যুবক খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ৭ এপ্রিল রাতে নগরীর জাতিসংঘ শিশুপার্কে আয়োজিত ঈদ মেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধের জেরে পলাশকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেটে আঘাত করে সন্ত্রাসীরা। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। রাতে জরুরি ভাবে অপারেশন করা হলেও, সকালে তার মৃত্যু হয়। ৩ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে ফুলতলা উপজেলার খুলনা-যশোর মহাসড়কের সুপার ব্রিকসের সামনে ফুলতলা উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহবায়ক শেখ আবুল বাশারকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা বোমা নিক্ষেপ করে। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি।

একই বছরের ২০ জানুয়ারি পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মানিক হাওলাদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি রাতে নগরীর তেঁতুলতলা মোড়ে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণব কুমার সরকারকে হত্যা করে। ২৩ জানুয়ারি সকালে খুলনায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মন্টু শেখ (৪৫) নামে বিএনপির এক কর্মীর দুই চোখ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। দিঘলিয়া উপজেলার দক্ষিণ চন্দনীমহল মালোপাড়া নারদের দোকানের সামনে এ ঘটনা ঘটে। একইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সন্ত্রাসীর গুলিতে জিয়া প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইকরাম হাওলাদার আহত হন। রূপসা উপজেলার ১ নম্বর আইচগাতি ইউনিয়নের ঠান্ডার বাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে নগরীর টুটপাড়া এলাকায় গুলি ছুড়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর আহত করে সন্ত্রাসীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। গত ৩০ মার্চ নগরীর আরামবাগ এলাকার একটি বাড়িতে মধ্যরাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ২৬ মার্চ নগরীর পশ্চিম টুটপাড়া এলাকার কবি নজরুল ইসলাম সড়কের জুলহাসের চায়ের দোকানের সামনে মো. কামাল নামের এক যুবককে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত করে সন্ত্রাসীরা। সে নগরীর মুক্তা কমিশনার কার্লভার্ট এলাকার মো. আব্দুল মালেকের ছেলে। ৩০ মার্চ রাতে খুলনার তিনটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুটি রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের পূর্ব রূপসা এলাকায় ও একটি নগরীর রূপসা বেড়িবাঁধ রোডের বরফ কলের সামনে।

খুলনা নগরীতে বসবাসকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, ৫ আগস্টের পর নগরীতে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া ওয়ে উঠেছে। প্রায়ই হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। যে কারণে সবার মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরীতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন শহরে খুন, ছিনতাই, লুটপাট, ডাকাতি ও ধর্ষণসহ একাধিক অপরাধের ঘটনা ঘটছে। যেখানে সেখানে মানুষকে আঘাত করা, ছুরিকাঘাত, গুলি ও বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে একটি সন্ত্রাসী চক্রের আশ্রয়ে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। পুলিশ, র‍্যাবসহ যতগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, তারা যদি আরও বেশি সক্রিয় হতে না পারে, তাহলে আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন নিরীহ মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। কারণ, কোথায়-কখন-কোন বিপদের মধ্যে পড়বে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া দরকার। চিহ্নিত সন্ত্রাসী যেগুলো আছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার হওয়া দরকার।’

এ প্রসঙ্গে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরীর আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভালো না। এরই মধ্যে অনেকগুলো খুন হয়েছে। এ ছাড়া, কিশোর গ্যাং ও মাদকে নগরী ছেয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির যে অবস্থা তাতে মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।’

বিএনপি নেতাদের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, সেই স্বৈরাচারের দোসররা হামলা করেছে। তারা দীর্ঘ ১৭ বছর চেষ্টা করছে। তারা কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় এই চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের এই শক্তভাবে প্রতিহত করা হবে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ খুলনা মহানগরের সহ-সভাপতি শেখ মো. নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুলনা মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। প্রতিদিন কোন না কোন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, মানুষ নিহত হচ্ছে। এটা আসলে কাম্য নয়। আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা আগের অবস্থানে ফিরে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও কিছু কিশোর গ্যাং আধিপত্য বিস্তার করছে। বিভিন্ন জায়গায় তারা অপকর্ম করছে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. আহসান হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরীতে কিছু সন্ত্রাসী-হামলার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ঘটনার পর পরই খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। ঈদের আগে ও পরে চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে অবৈধ অস্ত্র। খুলনা নগরীকে আমরা নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছি। এজন্য যা যা করণীয়, সেটা আমরা করে যাচ্ছি। নগরীতে যে ঘটনাই ঘটুক না কেন এখন পর্যন্ত কেউ পার পায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে নগরীতে যাতে অপরাধমূলক কোনো ঘটনা না ঘটে, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর ঘটনা ঘটার পর তাৎক্ষণিক আমরা এর পেছনে যাদের ভূমিকা আছে বা থাকে তাদের আটক করছি। তাদের কাছে থাকা অস্ত্র উদ্ধার করছি।’

খুলনাকে দ্রুতই নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন এডিসি আহসান হাবিব।

সারাবাংলা/পিটিএম

অপরাধীচক্র খুন খুলনা চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী হামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর