ভারতে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল
অর্থনৈতিক প্রভাবের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি
৯ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০২ | আপডেট: ৯ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:১০
ঢাকা: বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এই সুবিধা বাতিলে অর্থনৈতিক প্রভাবের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাবকে বড় করে দেখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ। তবে ভারতের বিরুদ্ধে এখনই কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হবে না বলে মনে করছেন তারা। বরং, ভারতের কাছে প্রথম এর ব্যাখ্যা চাওয়ার পরামর্শ তাদের। ট্রানজিটসহ বহু সুবিধা নেওয়া ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করে বড় মনের পরিচয় দিতে পারেনি বলেও মন্তব্য কারও কারও।
এদিকে এই সুবিধা বাতিলের প্রভাবে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য পাঠাতে না পারলে দেশ দুটিতে বাংলাদেশের রফতানিও প্রায় স্থবির হয়ে পড়বে। ফলে এর পুরো সুবিধা পাবে ভারত। ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে পোশাক ও কৃষিপণ্যে বেশি প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া, রফতানি আয়েও সীমিত পরিসরে হলে ধাক্কা লাগবে। অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমের খবরে এসেছে, ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে আদেশ জারি করেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআই ও টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গার্মেন্টস খাতের ভারতীয় রফতানিকারকেরা দীর্ঘদিন ধরেই এই সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা অভিযোগ করছিলেন, প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০টি ট্রাক বাংলাদেশ থেকে দিল্লি বিমানবন্দর কার্গো টার্মিনালে প্রবেশ করে। ফলে ভারতীয় পণ্য রফতানি ব্যাহত হচ্ছে।
তাদের আরও অভিযোগ রয়েছে, বিমান সংস্থাগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে ও কার্গো প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। ফলে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তবে, কেবলমাত্র ব্যবসায়ীদের দাবিতেই এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে কিনা তা পরিষ্কার করেনি ভারত সরকার। এই সুবিধা বাতিলের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও থাকতে পারে বলে মনে করেছন বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালাগ (সিপিডি) এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের অর্থনৈতিক প্রভাব খুব বড় নয়। আমরা খুব বড় আকারে নেপাল ও ভুটানে রফতানি করি না, অথবা দিল্লি বা কলকাতা পোর্ট ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে রফতানি- সেটিও তুলনামূলকভাবে খুব কম। এর অর্থনৈতিক প্রভাব খুব সীমিত। তার পরেও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা যেহেতু বাতিল হয়েছে, সেহেতু ওই দেশগুলো অন্য পথে পণ্য আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে েফলতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো তারা ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে। আবার আমরা যেহেতু কাঁচামাল জাতীয় বা কৃষিপণ্য রফতানি করি, পচনশীল হলে সেগুলোতেও অপচয় বাড়বে। ফলে এ ধরণের পণ্যও বাংলাদেশ থেকে নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ কমতে পারে। এদিক থেকে সেই প্রভাব কিছুটা হলেও আছে।’
এই অর্থনীতিবদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রভাবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ভারত কেন নিল? সেক্ষেত্রে যেটি হতে পারে, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া। ঠিক কোনো প্রেক্ষিতে কোনোধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল? এবং অনুরোধ করা তারা যেন এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তবে এটার পরিপ্রেক্ষিতে কোনোভাবেই বাংলাদেশের উচিত হবে না, কোন পালটা ব্যবস্থা নেওয়া।’
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নেপাল ও ভুটানে আমরা পণ্যের পুরোটাই স্থলপথে রফতানি করে থাকি। নেপালে রফতানি সম্ভবত ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। আর ভুটানের সঙ্গে ৪০ বা ৪৮ মিলিয়ন ডলার। এই দুই দেশে সীমিত আকারে রফতানি হয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমত এ ধরণের একটি সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক উপযোগিতা অবশ্যই আছে। এ দু’টি দেশে বাণিজ্য ব্যয়বহুল করে তুলবে। অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেশি। এরকম একটি সুবিধা কেন ভারতের পক্ষ থেকে বাতিল করা হলো, কোনো ধরণের আলাপ আলোচনা ছাড়াই, বরং সেটিই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
জাুনতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারা আমাদের কম সুবিধা দিয়েছিল। তাদের তো আমরা সবই দিয়েছি, ট্রানজিট দিয়েছি, ট্রান্সশিপমেন্ট দিয়েছিলাম আগে। এখন তারা এটাও বাতিল করছে। আমরা যে খুব সুবিধা নিতে পেরেছিলাম তাও না। ট্রান্সশিপমেন্ট মানে তো তাদের ট্রান্সপোর্টে যেতো। তাদের এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে ভালো কিছু মনে হলো না। তাদের এই সিদ্ধান্ত ন্যয্য মনে হলো না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে তারা তো অনেক কিছুতে উপকার পাচ্ছিল। আমরা যদি তাদের ট্রানজিটের অর্থও নেগোশিয়েট করে নিই, যেহেতু আগের সরকার নেয় নাই, তারপরেও তাদের জন্য উপকার অনেক বেশি। আমরা তাদের ট্রানজিট দেব না, সেটি কিন্তু বলি নাই। আমরা যেটা বলছিলাম, ট্রানজিটের প্রাইজটা পুনর্মূল্যায়ণ করতে হবে। ট্রানজিটে যাতে আমরা ন্যায্য ফি পাই তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ তো আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট বাতিল করেনি। বাংলাদেশ চাচ্ছিল ট্রানজিটের ন্যয্য ফি। এই যে আমাদের অবকাঠামো ব্যবহার করবে, আমাদের লাভ কী। আগের সরকার তো কোনোটিই ন্যয্যভাবে করেনি। আমরা তাদের জন্য রেললাইন তৈরি করে দিয়েছি, ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছি। আগের সরকার তো সবকিছু দিয়ে দিয়েছে।’
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে করণীয় বিষেয় অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে নেপাল ও ভুটানকেও সোচ্চার হতে হবে। কারণ ট্রান্সশিপমেন্ট হয়ে নেপাল ও ভুটানে পণ্য যাচ্ছে। এতে ওই দেশেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ থেকে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। একই দিনে ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে, যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ফলে ভারতীয় বন্দর ও বিমানবন্দরগুলো দিয়ে পণ্য পরিবহণের ওপর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে রফতানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের বাজারে পণ্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হবে। বাণিজ্য সহজতর করতে ও খরচ কমাতে এই সুবিধাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল। আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য লজিস্টিক খাতে চাপ বাড়বে, লজিস্টিক খাতে আঞ্চলিক বাজারেও প্রভাব পড়বে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘ ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের ফলে দেশের পোশাক খাতে প্রভাব পড়বে। ভারতীয় পোশাক উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা পাবে। তবে ভারতের এই পদক্ষেপ ডব্লিউটিও সঙ্গত নয়। ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারদের একটি। এবং এই নীতিগত পরিবর্তন ভবিষ্যতে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে, ভারত তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে, এবং উভয় দেশের জন্য উপকারী একটি সমাধান বের করতে আলোচনায় বসবে।’
ভারতের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্টে যা ছিল
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২০ সালের এক আদেশ অনুসারে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রফতানিতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের একটি শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। আর নতুন আদেশ অনুযায়ী সেই সুবিধাই বাতিল করা হয়েছে।
বর্তমানে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য যায়। ট্রান্সশিপমেন্ট হলো- বাংলাদেশের পণ্য নেপাল ও ভুটানে রফতানির সময় ভারতের ভূখণ্ড পাড়ি দিতে হয়। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল ও ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত পণ্যের যানবাহন (ট্রাক, টেইলর) পরিবর্তন করা হয়।
কী করতে পারে বাংলাদেশ
ভারত নিয়ম লঙ্ঘন করে থাকলে বাংলাদেশের পক্ষে ডব্লিউটিওতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার অধিকার রয়েছে। ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রথমে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার চেষ্টা করতে পারে। তাতে যদি সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশ বিষয়টি ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থা (ডিএসবি)-এর কাছে উত্থাপন করতে পারে। এখন বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে সময় সেটি বলে দেবে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম