Monday 31 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশকতায় অচল রবির অর্ধশত টাওয়ার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট 
২৮ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৩ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৬

রবির মোবাইল টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ফাইবার কেটে ফেলা হয়েছে

ঢাকা: নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অনেক জায়গায় রবির মোবাইল নেটওয়ার্কে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। গত তিন মাসে বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তরা রবির মোবাইল টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ফাইবার কেটে ফেলেছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় অর্ধশত টাওয়ার। এমনকি অপরাধী চক্র কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মীকে অপহরণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে টাওয়ারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না টাওয়ার কোম্পানি ইডটকো বাংলাদেশ লিমিটেডও।

বিজ্ঞাপন

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে কাজ করছে। তবে এখনো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রবি কর্তৃপক্ষ। রাজস্ব ও গ্রাহক নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে মোবাইল অপারেটর রবি। অন্যদিকে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয়। সেখানে পণ্য পরিবহণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে বিঘ্ন হচ্ছে। সবমিলিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে পার্বত্য তিন জেলা।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (২৮ মার্চ) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রবি আজিয়াটা এ তথ্য জানিয়েছে।

রবি বলছে, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, লক্ষীছড়ি, পানিছড়ি, দিঘীনালা, মানিকছড়ি, নানিয়ার চড়, রাওজান, ফটিকছড়ি, বাঘাইছড়িসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় কিছু অপরাধী গোষ্ঠী ৫১টি মোবাইল টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে ও ফাইবার কেটে ফেলেছে। প্রায় তিন মাস ধরে চলতে থাকা এ ধরনের কার্যকলাপের পেছনে চাঁদাবাজির উদ্দেশ্য রয়েছে বলে রবির অভিযোগ।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, অপরাধী চক্রের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে শুধু খাগড়াছড়িতেই ৩২টি টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সাতটি সচল করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনো বন্ধ রয়েছে ২৫টি টাওয়ার। এর মধ্যে কয়েকটি মাঝে মধ্যে সচল হলেও ফের তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পার্বত্য তিন জেলার অন্তত ২৬টি টাওয়ার সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ফাইবার কেটে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। দেখা গেছে কোথাও কোথাও ফাইবারগুলো ঠিক করা হলেও ওইদিনই তা আবার কেটে দেওয়া হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এ পর্যন্ত টাওয়ারগুলোর তিন জন নিরাপত্তা কর্মী অপহৃত হয়েছেন। অপরিচিত নম্বর থেকে রবির কর্মীদের নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। এমন স্পর্শকতার পরিস্থিতিতে টাওয়ার পুনরুদ্ধার কাজেও কোনো অগ্রগতি নেই। ইডটকো সাইটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও তা ঠিকভাবে পালন করতে পারছে না তারা। এতে আরও বেশি রাজস্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েছে রবি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ইডটকোর নিরাপত্তা দল এবং স্থানীয় প্রশাসন সমস্যাটির সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটির লক্ষ্য ছিল সার্বিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সমস্যার সমাধান করা।

এদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় ইডটকো কিছু টাওয়ার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেও দুর্বৃত্তদের আক্রমণে পুনরায় সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইডটকো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠির মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করেছে। এ ছাড়া রবির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স টিম বিটিসিএলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখছে, যাতে কোনো ফাইবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে দ্রুতই তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগে ইডটকোকে সহযোগিতা করছে রবি। ইডটকো, রবি ও সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া ইডটকো ও রবি টিম প্রতিদিন যৌথভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল টাওয়ার এভাবে বন্ধ থাকার ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে মানুষকে। মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক না থাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ সরবরাহ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণ বিঘ্নিত হচ্ছে। সেখানকার অনেক দুর্গম এলাকায় মোবাইল যোগাযোগই একমাত্র ভরসা। কিন্তু টাওয়ার বন্ধ থাকায় রোগীরা হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে পারছেন না। এমনকি জরুরি মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সও ডাকা যাচ্ছে না। ফলে দুর্ঘটনায় আহত, গর্ভবতী নারী বা সংকটাপন্ন রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থায়ও নেমে এসেছে বিপর্যয়। কারণ ফার্মেসি ও সরবরাহকারীরা সময়মতো অর্ডার বা সমন্বয় করতে পারছেন না। বিশেষ করে ইনসুলিন, অক্সিজেন বা জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। দ্রুত মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

রবির মোবাইল টাওয়ার বন্ধ থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্যসামগ্রী ও কাঁচামাল অর্ডার বা সরবরাহে দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে নেটওয়ার্কের অভাবে পরিবহণ পরিচালনায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহণ ব্যবসায়ীরা চালকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় পণ্যবাহী যানবাহন সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। কমে যাচ্ছে খাদ্য, শিশুখাদ্য ও গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ। ফলে কোথাও কোথাও মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকট তৈরির ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া স্থানীয় কৃষকেরাও নানা সমস্যায় পড়েছেন। উৎপাদিত পণ্য শহরে পাঠানোর জন্য ক্রেতা বা আড়তদারদের সঙ্গে ঠিকভাবে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না তারা। ফলে অনেক জায়গায় পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা কৃষকরা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধার করা না হলে স্থানীয় বাজারে খাদ্য সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ির বাসিন্দা রবিউল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকভাবে কাজ করছে না। আমরা এ পরিস্থিতিতে খুবই বিপদে পড়েছি। অনেক সময় তো জরুরি যোগাযোগও করতে পারি না। বিশেষ করে রোগী হলে অথবা কোনো দুর্ঘটনা হলে দ্রুত সাহায্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ফার্মেসিতেও ওষুধপত্র সব পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত টাওয়ারগুলো চালু না হলে সংকট আরও বাড়বে।’

রাঙ্গামাটি সদরের বাসিন্দা জুনাং তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাওয়ারের সমস্যা চলতে থাকায় যোগাযোগে খুবই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বাজারে গেলে অনেক জিনিসপত্র পাওয়া যায় না। টাওয়ারগুলোতে সন্ত্রাসী হামলার কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়েও আমরা খুব শঙ্কার মধ্যে আছি। আমরা চাই, সরকারের সহায়তায় দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হোক, না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত মোবাইল টাওয়ারগুলো চালু করা ও সেখানকার নিরাপত্তা জোরদার করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রবি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাওয়ার সমস্যার দ্রুত সমস্যা সমাধান না হলে রাজস্ব ও গ্রাহক হারিয়ে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রবি। পাশাপাশি আরও বেশি সংকটে পড়বে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ও সেখানকার অর্থনীতি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এইচআই

নেটওয়ার্ক পার্বত্য চট্টগ্রাম মোবাইল নেটওয়ার্ক রবি সংযোগ বিচ্ছিন্ন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর