২৪ মার্চ ১৯৭১
সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ দিবসে শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি
২৪ মার্চ ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:০৬
ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। এদিন শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। এদিকে করাচি থেকে ‘সোয়াত’ জাহাজে করে আনা পাঁচ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র নামাতে বাঙালি শ্রমিকরা অস্বীকৃতি জানান এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এমনকি অবরোধ করে রাখেন জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক। এ ছাড়া, সৈয়দপুরে বিহারি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদিন গণহত্যা চালায়।
এদিন শেখ মুজিবের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় তিন ঘণ্টার ওই বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অবিলম্বে সংসদ অধিবেশনে ডেকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছি।’
একাত্তরের এইদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসভবনে আগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে তিনি প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের (২৫ মার্চ, ১৯৭১) মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না। আমি কঠোর সংগ্রামের জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানি না। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। মানুষের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।’
পূর্বপাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’- গান গাইতে গাইতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন। ভোলা এবং বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলি, আন্দোলনরত বাঙালির ওপর নির্যাতন, চরম দুর্ব্যবহার ও পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের চাপের মুখে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সর্বস্তরের বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী কাজ বর্জন করে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ফলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা টিভির সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়।
সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০ নম্বর সেক্টরে একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়। বোমা হামলা করা হয়। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, মিরপুরে অবাঙালিরা সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারিরা সেখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলস ব্যাটালিয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দ্রুত পৌঁছে যায় সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে। সুযোগ বুঝে বাঙালি নিধন কর্মসূচি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের নীল নকশা শুরু করে। ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া-টিক্কারা গোপন বৈঠক করে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেও অপারেশন শুরুর নির্দেশ জারি করে। গোপনে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে।
এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশজুড়ে প্রচার চালাতে থাকে যে, ভারতীয় হিন্দুবাদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতেই পূর্বপাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুশমনি শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।
সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম