বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপ যাতায়াতে চালু হচ্ছে ফেরি, উদ্বোধন কাল
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিনের সূচনা হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলার সড়ক অবকাঠামো থেকে নৌপথে প্রায় ১০ মাইল পাড়ি দেওয়ার জন্য চালু হচ্ছে ফেরি সার্ভিস। যুগ যুগ ধরে যাত্রাপথের সীমাহীন ভোগান্তি, প্রাণহানি, আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির বেড়াজাল পেরিয়ে প্রাপ্তির সূচনায় উচ্ছ্বাসের ঢেউ লেগেছে সন্দ্বীপবাসীর মধ্যে। প্রাণের জনপদ নিয়ে তারা এখন বুনছেন নতুন নতুন স্বপ্ন।
সোমবার (২৪ মার্চ) সকালে ফেরি সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহণ উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন। এ উপলক্ষ্যে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
বঙ্গোপসাগর পাড়ের দ্বীপ উপজেলা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের আরেক তীরে চট্টগ্রামের স্থলভাগ সীতাকুণ্ড উপকূল থেকে নৌপথে সন্দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। মাঝে বঙ্গোপসাগরের চ্যানেল। নৌপথ পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ পৌঁছানো রীতিমতো যুদ্ধের মতো ছিল বিচ্ছিন্ন এ জনপদের মানুষের। মৌসুমের স্বাভাবিক সময়ে ছোট-বড় নৌযানে কোনোমতে সন্দ্বীপ পৌঁছানো গেলেও তীরে নেমে দীর্ঘ কাদায় ঢাকা পথ পাড়ি দিয়ে মূল সড়কে উঠতে হতো যাত্রীদের। আর বর্ষাকালে সাগর উত্তাল থাকলে সন্দ্বীপ পৌঁছানো রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল।
নিয়মিত ঘটেছে অংসখ্য প্রাণহানি। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ উপকূলে পৌঁছানোর পর সি-ট্রাক থেকে যাত্রী নামানোর সময় ‘লালবোট’ (উপকূলে যাত্রী নামানোর ছোট নৌকা) ডুবে ১৮ জন প্রাণ হারান। এ ঘটনা ‘সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল স্পিডবোট ডুবে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। বছরের ১৯ আগস্ট কাঠের তৈরি ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে সাগরে পড়ে এক ব্যক্তি মারা যান।

বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে যাতায়াতে চালু হচ্ছে ফেরি। ছবি: সংগৃহীত
এ অবস্থায় নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রামে আন্দোলন গড়ে তোলে ‘আমরা সন্দ্বীপবাসী’সহ বিভিন্ন সংগঠন। সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল-সেমিনার, জনপ্রতিনিধিদের কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলেন সংগঠকরা। দলমত নির্বিশেষে সন্দ্বীপের মানুষ এক কাতারে আসেন দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপে দু’প্রান্তে জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১০ বছর ধরে জেটিগুলো অব্যবহৃত থাকার পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফেরি সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু অবকাঠামো জটিলতায় সেই সিদ্ধান্ত আটকে ছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান সন্দ্বীপের সন্তান মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। উপদেষ্টা ফাওজুলের তদারকিতে অবকাঠামো নির্মাণ ও ফেরি সার্ভিস চালুর কার্যক্রমে গতি আসে।
গত ১৯ মার্চ দুপুরে নির্ধারিত ফেরি ‘কপোতাক্ষ’ পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া প্রান্ত থেকে যাত্রা করে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো সন্দ্বীপের যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। ফেরি আসার খবরে সেদিন সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া প্রান্তে শত, শত মানুষ প্রবল আগ্রহ নিয়ে ভিড় জমায়। এরপর ২৪ মার্চ থেকে ওই রুটে নিয়মিত ফেরি চলাচল শুরুর ঘোষণা দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএ’র উপপরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলকভাবে ফেরি নিয়ে সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপে পৌঁছাতে তাদের সোয়া এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগর উত্তাল না থাকলে ফেরি চলাচলে এর বেশি সময় লাগবে না। আপাতত কপোতাক্ষ ফেরিটি দিনে একবার সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ যাবে এবং সেখান থেকে আবার ফিরে আসবে।
ফেরি দিয়ে বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, মিনিবাস, প্রাইভেটকারসহ সবধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ফেরির মোট ধারণক্ষমতা ২৪টি পণ্যবোঝাই ট্রাকের সমান। তবে এই রুটে চলাচলের জন্য আরও একটি ফেরি নির্মাণাধীন আছে বলে তিনি জানান।
‘আমরা সন্দ্বীপবাসী’ সংগঠক সাংবাদিক সালেহ নোমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফেরি সার্ভিস চালুর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ঘটনা যেটি ঘটছে সেটি হলো, দেশের বিচ্ছিন্ন একটি জনপদ মূল যাতায়াত অবকাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। এখন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে মানুষ সরাসরি সন্দ্বীপে চলে যেতে পারবে। এতে সন্দ্বীপ নতুন করে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে। এ জনপদের ৫০ হাজার মানুষ আমেরিকা প্রবাসী। এখানে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। অথনৈতিকভাবে অনেক পরিবর্তন আসবে। সন্দ্বীপ একটি মডেল উপজেলা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।’
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী আরিফ বিল্লাহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ নৌপথে ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সোমবার সকালে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে সমাবেশ হবে। এতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন।
সমাবেশে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বক্তব্য দেবেন।
এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী ও অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান সমাবেশে বক্তৃতা করবেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম