সাবেক এমপির ‘ভাগনেদের’ ফাঁসি চেয়ে পোস্টার
২১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪২ | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:২৪
রাজশাহী: চার ভাইয়ের এক ভাই ছিলেন পৌরসভার কাউন্সিলর। বাকি তিন ভাই নানা ব্যবসায় যুক্ত। চারজনই আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের পদধারী। অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ এই চার ভাই কাউন্সিলরশিপ আর অন্য ব্যবসার আড়ালে চালাতেন মাদক ব্যবসা। সাবেক এই এমপিকে তারা ডাকতেন ‘মামা’। ওমর ফারুক চৌধুরীও তাদের ‘ভাগনে’ বলে সম্বোধন করতেন। এই চার ভাইয়ের ফাঁসি চেয়ে এলাকায় সাঁটানো হয়েছে পোস্টার।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় এ পোস্টার দেখা যাচ্ছে। তবে কে বা কারা এসব পোস্টার সাঁটিয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে পোস্টারে ‘মাদক ব্যবসায়ী’ চার ভাইয়ের ছবি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কার নামে কতটি মাদকের মামলা আছে তার বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনমালে এ চার ভাই রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের টানা চার বারের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর দাপটে চলতেন।
চার ভাই হলেন- গোদাগাড়ী পৌরসভার মাদারপুর মহল্লার মজিবর রহমানের ছেলে মনিরুল ইসলাম (৪৩), মেহেদী হাসান (৪১), সোহেল রানা (৩৯) ও আবদুর রহিম টিপু (৩৭)। এদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম গোদাগাড়ী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মাদকের মামলা আছে। পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পোস্টারে চার ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, মনিরুল ইসলাম ৩ নস্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আবদুর রহিম টিপু গোদাগাড়ী পৌর যুবলীগের নেতা এবং মেহেদী হাসান ও সোহেল রানা উপজেলা যুবলীগের সহসম্পাদক।
এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পৌরসভা ও থানার সীমানা প্রাচীরসহ বিভিন্ন এলাকায় চার ভাইয়ের ছবিসহ পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। পোস্টারে প্রত্যেকের ছবির নিচে তাদের নামে থাকা মাদকের মামলা নম্বর, ধারা এবং কোন থানায় মামলা দায়ের হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
এতে দেখা যায়, সাবেক কাউন্সিলর মনিরুলের বিরুদ্ধে দুটি ও আবদুর রহিম টিপুর নামে দুটি মাদকের মামলা আছে। মেহেদী ও সোহেল রানার নামে আছে একটি করে মাদকের মামলা। মেহেদীর নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আছে বলেও পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ গত বছরের ৭ মে চার কেজি ৩০০ গ্রাম হেরোইন পাচারের অভিযোগে গোদাগাড়ী থানায় টিপুর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। সাবেক এমপি ফারুক চৌধুরীর আশীর্বাদে কাউন্সিলর হওয়া মনিরুল ইসলাম ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল পৌনে চার কেজি হেরোইনসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আরেকটি মাদক মামলা হয়।
মনিরুলের ভাই টিপু রাজশাহীর অন্যতম শীর্ষ মাদক কারবারি। ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাজশাহীর শীর্ষ ১৫ মাদক কারবারির নামের তালিকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় নাম ছিল টিপুর। টিপুর বিরুদ্ধেও গত বছরের ৭ মে গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা হয়। আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এই চার ভাই হন লাপাত্তা।
অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা এই চার ভাই গত ১০ বছরে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। রাজশাহী নগরীর আলীগঞ্জ নিমতলায় ২৮ কোটি টাকায় জমিসহ চারতলা বাড়ি রয়েছে এই পরিবারের। বাড়ির নিচতলায় আছে মার্কেট। রাজশাহী নিউমার্কেটে তমা কালেকশন, তমা ফ্যাশন ও তমা সুজ নামে ৯৬, ৯৭ ও ১০০ নম্বর দোকানগুলোর মালিক টিপু। সাহেববাজারের আরডিএ মার্কেটে রয়েছে একাধিক দোকান। গোদাগাড়ীর হাবাসপুরে আছে খামার।
এ ছাড়া গোদাগাড়ী পৌরসভার মাদারপুর মহল্লায় আছে তিনটি বাড়ি। এরমধ্যে একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে বসবাস করে পুরো পরিবার। অন্য দুটি একতলা বাড়ি পড়ে আছে। মহিষালবাড়ী বাজারে আছে চারটি দোকান। এরমধ্যে একটি জুয়েলারি দোকান। তমা ইলেকট্রিক নামের দোকানটিতে বসতেন মনিরুল। মুনিয়া গার্মেন্ট ও আনুশকা গার্মেন্টে বসতেন অন্য দুই ভাই।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এই পরিবারের ৬৬ বিঘা ধানি জমি রয়েছে। এ ছাড়া নদীর ওপারে চরে আছে আরও ২১ বিঘা জমি। কাউন্সিলর মনিরুল চড়েন একটি দামি গাড়িতে। আরেকটি মাইক্রোবাসে চড়েন টিপু। আরেকটি সাদা মাইক্রোবাস ও মাছ পরিবহণের জন্য একটি ট্রাক আছে তাদের।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তৎকালীন এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীকে একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস উপহার দিয়েছিলেন টিপু। গাড়িটি টিপুর নামেই রেজিস্ট্রেশন করা ছিল। গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশ হলে ফারুক চৌধুরী তখন দাবি করেছিলেন, টিপুর কাছ থেকে তার ছেলে গাড়িটি কিনেছেন।
চার ভাইকেই গ্রেফতারের জন্য পুলিশ খুঁজছে বলে জানিয়েছেন গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রুহুল আমিন। সোমবার দুপুরে তিনি বলেন, ‘চার ভাইয়ের নামে এলাকায় পোস্টার আমিও দেখেছি। তাদের তো আমরাও খুঁজছি। খোঁজ পেলেই গ্রেফতার করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এরা পাঁচ ভাই। এরমধ্যে চার ভাই মাদক কারবারে জড়িত বলে এলাকার মানুষ জানেন। আমি আগে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) ছিলাম। তখন এক ভাইকে মাদকসহ গ্রেফতার করেছিলাম। পরে জামিন পেয়ে বেরিয়ে যায় এবং আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ে।’
সারাবাংলা/ইআ