ঢামেকের হিমঘরে ৭ মরদেহ, চামড়া উঠে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না
২০ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫১ | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:৫৩
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত সাত জনের মরদেহ এখনো পড়ে আছে। এরমধ্যে ছয়জন পুরুষ আর একজন নারী। ছয় মাস ধরে মরদেহগুলো পড়ে থাকলেও পরিচয় শনাক্তের অভাবে হস্তান্তর করা সম্ভব হয় নি।
দীর্ঘদিন হিমঘরে থাকায় বিকৃত হয়ে গেছে মরদেহগুলো। চামড়া উঠে যাওয়ায় তাদের আঙুলের ছাপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বজন হারানো কেউ না কেউ এসে মরদেহগুলো দেখছেন। কিন্তু বিকৃত হয়ে যাওয়ায় কেউ এখন পর্যন্ত তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেন নি। ডিএনএ পরীক্ষা না করে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না- বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও চিকিৎসকরা।
ঢামেক মর্গ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মরদেহগুলো এসেছে। কলেজ মর্গে এসেছে ১৬ আগস্টে। এরমধ্যে জরুরি বিভাগ থেকে মরদেহগুলো ভালমত সংরক্ষণ না করায় সেগুলো বিকৃত হয়ে গেছে।
মরদেহের ময়নাতদন্তে একজনের মৃত্যু লেখা রয়েছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে এবং খাতায় লেখা এনামুল নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে ‘ওপর থেকে নিচে পড়ে’। তবে নিহত এনামুলের নাম পাওয়া গেছে হাসাপাতালে টিকিট থেকে। আর কোনো তথ্য দিতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ। কয়েকজনের মরদেহের বিষয়ে হাসপাতালে এন্ট্রি খাতায় বাহকের নাম হিসেবে দেওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ক্যাম্পের সরকারি মোবাইল নম্বর।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শাহবাগ থানার মাধ্যমে আসা অজ্ঞাতনামা মরদেহগুলো হলো- পুরুষ (২০), অজ্ঞাত পুরুষ (২৫), অজ্ঞাত পুরুষ (২২), অজ্ঞাত নারী (৩২), অজ্ঞাত পুরুষ (৩০) ও এনামুল (২৫)। এছাড়া যাত্রাবাড়ী থানার মাধ্যমে আসা অজ্ঞাত পুরুষ (৩২)।
গত রোববার ১০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে দুটি মরদেহ শনাক্তের দাবি করেন স্বজনরা। সেলিনা বেগম নামে এক নারী ও তার স্বামী কাবিল হোসেন (৫০) এবং নুরে আলম নামে এক যুবক তার ভাতিজা হাসান (২২) নামে মরদেহ শনাক্তের দাবি করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিহত হাসানের চাচা নুরে আলম বলেন, তাদের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার কাছিয়া সাহা মাদার গ্রামে। হাসান যাত্রাবাড়ি সুতিখালপাড় বালুর মাঠ এলাকায় থাকতেন। এবং গুলিস্তান এরশাদ মার্কেটে একটি ইলেক্ট্রিক দোকানে কাজ করতেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে হাসান ছিলেন বড়।
তিনি আরও বলেন, হাসান গত ৫ আগস্ট বিকেলে সুতিখালপাড়ের বাসা থেকে বের হয়। এরপর আর বাসায় ফিরে নি। অনেক হাসপাতালে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। এক যুবকের পায়ে তার প্যাচানো অবস্থায় যাত্রাবাড়ি রাম্তায় পরে থাকা একটি ছবি ভাইরাল হয়। সেই ছবিটাই হাসানের মরদেহ ছিল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে কয়েকবার এসে ৬টি মরদেহ দেখে গেছি। তবে সনাক্ত করতে পারি নাই। দুইদিন আগে ফেসবুকে কয়েকটা ছবি দেখে আবার ঢাকা মেডিকেলে আসি এবং একটি মরদেহ ভাতিজা হাসানের সাথে মিলে যায়। তবে এর আগে কয়েকবার এসেছি, এই মরদেহটি দেখতে পাইনি।
সেলিনা বেগম বলেন, তাদের বাসা মানিকনগর এলাকায়। গত ৫ আগস্ট সকালে মানিকনগর বাসা থেকে কাবিল হোসেন বের হন। সেই দিনের পর তিনি আর বাসায় ফিরে আসেনি। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর কোথাও পায়নি।
ফেসবুকে মাধ্যমে দেখতে পায় ছয়টি মরদেহ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রয়েছে। এরপর শনিবার সন্ধ্যার দিকে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে ফ্রিজে থাকা স্বামী কাবিল হোসেনের মতই একটি মরদেহ দেখতে পাই। তবে তার বয়স ও দাড়ি দেখে একটু মনে হচ্ছে। তবুও আমরা ডিএনএ নমুনা দেব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের (ইনচার্জ) রামু দাস বলেন, আমাদের এখানে সাত জনের মরদেহ আছে। এরমধ্যে ছয় জনের মরদেহ এসেছে শাহবাগ থানার মাধ্যমে এবং এক জনের মহরদেহ যাত্রাবাড়ীর থানার মাধ্যমে। মরদেহ গুলের ময়নতদন্ত হয়েছে এবং প্রত্যেক মরদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মরদেহগুলো শনাক্ত করতে প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ আসছেন। প্রথমদিকে অনেকেই আসতেন। বর্তমানে দুয়েকজন আসেন। কিন্তু মরদেহগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ায় কেউ চিনতে পারছে না এবং শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। একজনের নাম এনামুল পাওয়া গেলেও কোনো স্বজন পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময়ে ছয়টি মরদেহ বেওয়ারিশ মরদেহ পুলিশের মাধ্যমে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে দেওয়া হয়েছে। আর এখনও যারা মরদেহের খোঁজে আসেন, তাদের ডিএনএ টেস্টের জন্য শাহবাগ থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান বলেন, জুলাই-আগস্টের মধ্যে যে মরদেহগুলো আমাদের এখানে এসেছে, তাদের অনেকের আমরা ময়নাতদন্ত করেছি। এখনো সাতজনের মরদেহ হিমাগারে রয়েছে। আর এগুলো যেহেতু অজ্ঞাত এবং শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা পুলিশের কাছে মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দিয়েছি এবং মরদেহগুলো বুঝিয়ে দিয়েছি। আর যেহেতু মরদেহগুলো শনাক্ত হয়নি তাই পুলিশ আমাদের অনুরোধ করেছিল মরদেহগুলো হিমাগারে রেখে দিতে। সে জন্যই রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে, ছয় জনের পুরুষের মধ্যে এক জনের দেহে শর্ট গানের গুলি ছিল। আর নারীসহ বাকিদের বিভিন্ন ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আর আমরা যেহেতু ময়নাতদন্তের পরপরই পুলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছি, তাই এখন পুলিশের দায়িত্ব তারা কীভাবে শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবে।
শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মুনসুর বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে কয়েকটি মরদেহ সংরক্ষিত রয়েছে। চামড়া উঠে যাওয়ায় মরদেহের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মরদেহগুলো প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে দেখে যান, কিন্তু কেউ এখন পর্যন্ত পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেন নি। কেউ শনাক্ত করেন কি না, সেই জন্যই ঢামেকে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। যারা আসছেন তাদের ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য সিআইডি ফরেনসিক বিভাগে পাঠনো হচ্ছে। আমাদের বেতার বার্তা ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেওয়া আছে। সুতরাং মরদেহগুলো নিয়ে আমাদের কাজ চলছে।
এর আগে, ১০ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলন ছয় জনের বেওয়ারিশ লাশের তথ্য প্রথমে সামনে আনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণঅভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেল।
বিশেষ সেলের সেক্রেটারি হাসান ইনাম বলেন, রুটিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, ঢামেক হাসপাতালে গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ছয় জনের বেওয়ারিশ মরদেহ রয়েছে। শুক্রবার সকালে সেলের একটি টিম এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য শাহবাগ থানায় যায় এবং ওই থানার ওসি ছয়টি মরদেহ এখনোও হিমাগারে থাকার তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি আরও বলেন, শাহবাগ থানা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, মরদেহগুলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের। তাই আমরা বিশ্বাস করি, তারা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের শহিদ। তবে মরদেহগুলো কবে এখানে আনা হয়েছে, পুলিশ তা স্পষ্ট করেনি। কারও পরিবারের সদস্য নিখোঁজ থাকলে ০১৬২১৩২৪১৮৭ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিষয়ক বিশেষ সেলের নেতারা।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ২৫২ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬২ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয় হয়। বাকি ৮৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। হাসপাতাল থেকে আহত মোট চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজার ৭০০ রোগী। আর বর্তমানে ভর্তি আছেন ১৩ জন। তাদের সবার অবস্থা গুরুতর। কারও মাথা কিংবা পেটে-পিঠে বা অন্য কোথাও গুলি লেগেছে। আবার কারও হাড় জোড়া লাগানো সমস্যা এবং প্লাস্টিক সার্জারি রোগী আছেন। আর ১৩ জনের মধ্যে ছয় জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এরমধ্যে পাঁচজনকে থাইল্যান্ড ও একজনকে টার্কিতে পাঠানো হচ্ছে। তিনজন রোগীর বিদেশে যাওয়ার কাগজপত্র প্রস্তুত রয়েছে। বাকি তিনজনের কাগজপত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসএসআর/ইআ