Sunday 19 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা
৪ মাস সময় দিলেন উপদেষ্টারা, ব্যর্থতায় শাস্তির হুঁশিয়ারি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৫৫ | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০১

বর্ষায় এরকমই জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আগামী বর্ষার আগে করণীয় হিসেবে ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং টিম। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে আগামী মে পর্যন্ত চার মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে সংস্থাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা এবং প্রকল্পের অর্থছাড় বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৯ জানুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্তসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ফারুক-ই-আজম, বীরপ্রতীক। সভায় উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান উপস্থিত থাকার কথা বলা হলেও তিনি ছিলেন না। সভায় বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মতামত শুনে তিন উপদেষ্টা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কর্মপরিকল্পনাগুলো তুলে ধরে সভায় বলেন, ‘চার মাস সময়, এটা আমরা করি। আপনি যদি কোনো ফল না পান, শুধু শুধু টাকা ঢেলে তো লাভ হবে না। আমরা দৃশ্যমান একটি সুফল পাব বলে আশা করি। বর্ষায় আমরা আবার আসব। আমাদের যে চার জনকে (উপদেষ্টা) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমরা যদি ফেল করি তখন এটার জন্য দায় নেব এবং এর জন্য যারা দায়ী ও আমাদের ফেল করতে বাধ্য করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব।’

‘অন্যবারের উদ্যোগ আর এবারের উদ্যোগের মধ্যে পার্থক্য আছে। এবার যারা ফেল করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ আছে। সেকেন্ডারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার যে জনউদ্যোগ নেওয়া হবে সেটা দেখার জন্য আদিলুর রহমান খান সাহেব আছেন, আমাদের আরেক উপদেষ্টা, উনি এসে কাজটি শুরু করবেন। এখানে কিন্তু প্রতিনিয়ত মনিটরিং হবে। আসছি আবার চলে গেলাম বা আতিথেয়তা- এগুলো হবে না। প্রতিটি দফতরের প্রধান যারা আছে ঢাকা থেকে এসে তারা মনিটরিং করবেন। আমরা এসে মনিটরিং করব। যিনি ফেল করবেন, তাকে এটার দায় নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সভার শুরু থেকে আমরা সরকারি সব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যেসব শুনেছি, সেটা হচ্ছে পুনরুদ্ধার ও আর্থিক বিষয়। এখানে যে টাকা খরচ হয়েছে সেটার সুফল যেহেতু মানুষ পায়নি, সেজন্য নতুন টাকা বরাদ্দ দেওয়া কিন্তু ভয়ানক সমস্যা। যেখানে যাবেন, সেখানে জিজ্ঞেস করবে তোমাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল আগে সেটার কি হলো? কি উপকারে আসল? এজন্য এটা একটি বড় সমস্যা। নালা, নর্দমা ও খাল পরিষ্কার করা হচ্ছে না এবং বর্জ্যতে সেগুলো ভরে গেছে একথাও এসেছে। এটার ব্যাপারে বলব- সিটি করপোরেশনের এসব পদে অনেক লোক নিয়োগ করা আছে। তাদের কাছ থেকে কোনো কাজ পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।’

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৫ দিনের জন্য এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সামাজিক আন্দোলনের মতো করে কাজ করতে হবে। আমরা হাজারখানেক লোক নিয়োগ দেব। ১৫ দিনের মতো সময় দিয়ে তাদের পরিষ্কার করার সরঞ্জামাদি দিয়ে দেওয়া হবে। এগুলো দিয়ে আমরা সেকেন্ডারি খাল ও নালার বর্জ্য পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে ফেলব। পুনরুদ্ধারের জন্য যেসব প্রজেক্ট ও সুইচ গেইট আছে সেসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করবে। আর যেসব মামলা আছে আমরা সেসবের তালিকা নিয়ে যাব। মামলাগুলো যাতে দ্রুত সুরাহা হয় সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নেব। জমি অধিগ্রহণের যে সমস্যা আছে সেগুলো আমরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্বরান্বিত করব।’

 

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্তসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন উপদেষ্টা মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্তসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন উপদেষ্টা মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

পাহাড় কাটা বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের নদীগুলো ভরাট হলো কেন? পাহাড় থেকে মাটি এসে এটা হয়েছে। পাহাড় থেকে মাটি কাটা বন্ধ না হলে তো আবার ভরাট হবে। এজন্য পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আমরা একটি শক্ত অবস্থান নেব। পাহাড় কাটা বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনারকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেব যাতে পাহাড়ে বিদ্যুৎ না দেয়। এছাড়া ওয়াসার যেসব সংযোগ আছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা নিতে বলব। যেসব এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে, আমরা রিজওয়ানা আপা (বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা) থেকে সেসব তালিকা নিয়ে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করব। পাহাড় কাটার জন্য বিদ্যুৎ দেওয়া হবে এটা তো আমি মেনে নিতে পারি না।’

‘পাহাড় কাটা বন্ধ হলো, মাটি ভরাট হওয়াও বন্ধ হলো। কিন্তু বর্জ্যগুলো কোথায় যাবে ? সিটি করপোরেশন ও অন্যান্যরা ঘোষণা দিয়ে দেবেন, কেউ যদি বাইরে বা ড্রেনে ময়লা ফেলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। মোবাইল কোর্ট আমরা পরিচালনা করব,’– বলেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘খালের পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ভবনগুলো সরাতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। এক্ষেত্রে ভূমি প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। এ নিয়ে যত মামলা আছে, সেগুলো আমাদের দেবেন। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সেগুলোর একটা ব্যবস্থা করব। পাহাড়ের মাটি কাটার সঙ্গে জলাবদ্ধতার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলেও সেটা সবার পরে। আপনারা আগে বর্জ্য সরানোর ব্যবস্থা করেন। খাল-ড্রেন পরিষ্কার করেন। একটার পর একটা ব্যবস্থা নিলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেন, ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের সমন্বয় নিয়ে বিপর্যয় আমরা দেখেছি। আবর্জনামুক্ত করে খালগুলো যারা নুতনভাবে তৈরি করছেন, তারা সেগুলো হস্তান্তর করে দিতে চান। কিন্তু যাদের হস্তান্তর করবে তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেই। বিষয়গুলো আমরা জানলাম। সমস্যা যখন আমরা চিহ্নিত করেছি সমাধানও আমরা করব।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘গত ১৬ বছর ধরে কোনো সমন্বয় ছিল না, এটাই মূল পয়েন্ট। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এক হয়ে প্ল্যান নিতো তাহলে এসব কথাগুলো আসতো না। এক সংস্থার প্রজেক্ট আরেক সংস্থার কাছে চলে গিয়েছিল। আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম সেসময় এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছি। তখন সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। আমরা এখন খুব আশাবাদী। কারণ আমাদের মধ্যে সমন্বয় আছে।’

চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘অতীতে যে বাজেটগুলো হয়েছে এবং সেখান থেকে ব্যয় করা হয়েছে এর পর্যালোচনা করা দরকার। ৩০০ কোটি টাকার বাজেট কীভাবে ১ হাজার ৩০০ কোটি হয়ে যায় সেটা আমাদের জানা দরকার। এটার পেছনে যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। খালের পাশে যেসব দখলদার আছেন তাদের বাড়ি ভেঙে ফেলেন। না পারলে আমাদের সহযোগিতা নেন।’

১১ দফা কর্মপরিকল্পনা 

১. চট্টগ্রাম শহরের সকল ধরণের পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।

২. চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া, যেসকল সুয়ারেজের লাইন সরারসি ড্রেনে উন্মুক্ত হয়েছে, সেসকল সুয়ারেজের লাইন স্থানান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩. চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্মাণাধীন ১৭ টি স্লুইচগেটের মধ্যে ১৫টি আগামী মে মাসের মধ্যে চালু করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন ২১ টি স্লুইচগেটের মধ্যে ১২টি একই সময়ের মধ্যে চালু করতে হবে।

৪. চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করাযর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৫. চসিককে বারইপাড়া খাল খননের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। মে মাসের মধ্যে এ খালের সকল বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে।

৬. চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রামের সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয় করবে। এ কমিটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সাংবাদিক/সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৭. চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পগুলোর আওতায় চলমান খাল খনন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খালগুলো দখলমুক্ত করার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে হবে।

৮ কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনট্যানেন্স ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯ . জলাবদ্ধতার হট স্পটগুলোতে পাম্পহাউজ চালু করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

১০. রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে আগামী মে মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে।

১১. প্রকল্পগুলোর বাইরে থাকা ২১ টি খাল ও ড্রেনের বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/পিটিএম

৪ মাস উপদেষ্টা চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা সময়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর