এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় ২ সন্ত্রাসীর দ্বন্দ্ব দেখছে পুলিশ
১২ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩০ | আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:৫৪
ঢাকা: রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দুই ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় শনিবার (১১ জানিয়ারি) রাতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। সেই মামলায় রোববার (১২ জানুয়ারি) দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ব্যবসায়ীকে কোপানোর পেছনের মূল কারণ হলো- দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর দ্বন্দ্ব ও চাঁদা আদায়। তবে অপরাধী যেই হোক না কেন পুলিশ কাউকে ছাড় দেবে না।
শনিবার রাতে নিউমার্কেট থানায় হত্যা চেষ্টার অভিযোগে যে মামলা হয়েছে সেই মামলার বাদী মারধরের শিকার ব্যবসায়ী দীপু। দীপু মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের বড় ভাই। পিচ্চি হেলাল গত বছরে পট পরিবর্তনের পর ১৫ আগস্ট জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান। আর ১৬ আগস্ট রাতে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার-৪ থেকে জামিনে মুক্তি পান অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ওরফে ইমন। কারামুক্তির পর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন বলে জানা গেছে।
মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখসহ ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হলেও প্রধান আসামি করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ওরফে ইমনকে (৫২)। মামলার অন্য আসামিরা হলেন– মুন্না (৪৭), আসিফ ঝন্টু (২৮), একেএম চঞ্চল (৪৩), শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সহযোগী খোকন (৪০), সাইদ আসাদ (৪১), জসিম ও কলা জসিম (৩৫), তুষার ওরফে কিলার তুষার (৩৫), তৌফিক এহসান (৬৩) ও মো. জাহিদ (৪৪)।
এ ঘটনায় মামলার ৩ নম্বর আসামি আসিফুল হক আসিফ ওরফে ঝন্টু (৩২) ও কাউসার মৃধা (২৪) নামে সন্দেহভাজন এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার আসিফ শরীয়তপুরের ডামুড্ডা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুল হক আকনের ছেলে। আর কাউসার মৃধা পটুয়াখালী মির্জাগঞ্জের কিসমত শ্রীনগরের মোহাম্মদ হালিম মৃধার ছেলে।
নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে দলবদ্ধ হয়ে এসে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনসহ অন্য আসামিরা মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে হয়রানি করে আসছিলেন।
আসামিদের চাঁদাবাজি ও হয়রানির বিরুদ্ধে বাদী ও অপর ভুক্তভোগী এহতেশামুল হকসহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী আইনি সহযোগিতা নেওয়াসহ ব্যবসায়ী ও ছাত্র-জনতাকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে অভিযুক্ত আসামিদের চাঁদাবাজি ব্যাহত হয়। মূলত এ কারণেই ভুক্তভোগী এহতেশামুল হকসহ রোষানলে পড়তে হয়। পরিকল্পিতভাবে আসামিরা পারস্পরিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ও প্ররোচণায় গত ১০ জানুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে নিউমার্কেট থানাধীন নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ই সি এস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার) পশ্চিম দিকে রাস্তার ওপর ধারালো ছোরা, চাপাতিসহ দলবদ্ধ হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে।
আরও পড়ুন: মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ীকে চাপাতি হাতে কোপাচ্ছে কারা?
বাদী আরও উল্লেখ করেন, আসামিদের এলোপাথাড়ি ধারালো ছোরা ও চাপাতির আঘাতে ভুক্তভোগী এহতেশামুল হকের কাঁধের জয়েন্ট, ডান হাতের কনুই, ডান পায়ের হাঁটু, বাম পায়ের পাতাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক গুরুতর জখম হয়। ওই সময় আমি নিচতলা (গ্রাউন্ড ফ্লোর) থেকে গাড়িতে করে বের হয়ে আসতে থাকলে আসামিদের কয়েকজন গ্রাউন্ড ফ্লোরের গেটের ভেতরে ঢুকে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। আসামিদের কোপের আঘাতে আমার গাড়ির কাচসহ বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্তসহ আমার বাম পা কেটে রক্তাক্ত জখম হয়। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সাধারণ জনতা এগিয়ে এলে আসামিরা ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমামুল হাসান হেলাল ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক, মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। বিএনপি ঘোষিত সব কর্মসূচি হেলালের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুর এলাকায় সম্পন্ন হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গ্রেফতারের পর পুলিশের প্রকাশিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় ওঠে পিচ্চি হেলালের নাম।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মোহাম্মদপুরের খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলাল গ্রেফতার না হলেও দুই-তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপরও পুলিশের নজরদারি রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী হোক বা যেই হোক, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের নেপথ্যে মার্কেটের কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ জেনেছি। মামলায় আসামি করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে। বাদী আবার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের বড় ভাই।’ নজরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে এবং চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।’
রোববার (১১ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগতভাবে উন্নতি ঘটেছে। এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় চাঁদাবাজির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় যারা যারা জড়িত সবাইকে গ্রেফতারের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনা মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম। তিনি বলেন, ‘এক মাস আগে ওই মার্কেটে একটি নির্বাচন হয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট একটি বিরোধ তাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আমাদের ধারণা এ নির্বাচনের কারণে ঘটনা হতে পারে, অথবা অন্য কোনো কারণেই হতে পারে। তবে আসামিদের না ধরা পর্যন্ত মূল বিষয়টা আমরা এখনই বলতে পারব না। আমরা চেষ্টা করছি।’
নিউমার্কেট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহসীন উদ্দিন বলেন, ‘এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় গতরাতেই থানায় মামলা হয়েছে। মামলার উল্লিখিত ৩ নম্বর আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন এক আসামিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
ওসি বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ফুটেজ ফরেনসিক করে আসামিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি এ ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে নেওয়া দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
মামলার প্রধান আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের তদন্ত টিম কাজ করছে। পাশাপাশি ডিবিও কাজ করছে। আশা করছি খুব শিগগিরই ধরা সম্ভব হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম