প্রকল্প অনুমোদনে ধীরে চলো নীতি
পাঁচ মাসে ৩৩ হাজার কোটি টাকার ২৩ প্রকল্প অনুমোদন
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:১৪
ঢাকা: উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় গত পাঁচ মাসে অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা ও ব্যয়ের পরিমাণ।
তথ্য বলছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদে এ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক হয়েছে চারটি। এসব বৈঠকে মোট প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২৩টি। এর মধ্যে নতুন ১৩টি এবং সংশোধিত প্রকল্প ১০টি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৪০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় ১১ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, বৈদেশিক সহায়তা ২০ হাজার ৮৯৯ কোটি ৪৯ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় করা হবে এক হাজার ৭৭৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে অনুষ্ঠিত একাধিক একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকার আস্তেধীরে এগুচ্ছে। চলমান বা নতুন যেকোনো ধরনের প্রকল্পই হোক, প্রকৃতপক্ষেই এর গুরুত্ব রয়েছে কি না -তা যাচাই করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে জনগণের কাজে লাগবে, এমন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় অহেতুক কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকলে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, চলমান অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সুদের হার বৃদ্ধিসহ নানা আন্দোলনের কারণে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রকল্পগুলো দুর্নীতিমুক্তভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে যেন উন্নয়নে গতি ফিরিয়ে আনা হয়।
ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, নতুন প্রকল্প নিয়ে বিশেষ সতর্কতা আছে। কেননা রাজনৈতিক প্রকল্প যেন পাস না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হচ্ছে। প্রকল্পে অপচয় বন্ধ করা হচ্ছে। নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সৃজনশীল ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ বেশ ভালোই কমবে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, পিডিরা (প্রকল্প পরিচালক) পালিয়ে যাওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্পের গতি কমেছে। ৫ আগষ্টের পর অনেক পিডি পদত্যাগ করেছেন। অনেকে পালিয়ে গেছেন। তারা এতটাই দুর্নীতি করেছেন যে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন— মাতারবাড়ি প্রকল্পের পিডি পালিয়ে গেছেন। যাওয়ার আগে সরকারি অনেক জিনিসপত্র বিক্রি করে গেছেন। এখন নতুন পিডি নিয়োগ দিতে হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ৮ আগস্ট সরকার গঠনের পর প্রথম একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। এতে চারটি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, এর মধ্যে নতুন প্রকল্প দুটি, বাকি দুটি পুরনো প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২২২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৯৬৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা, বিদেশি ঋণ থেকে ১০০ কোটি ১৬ লাখ টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৫৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
প্রথম একনেক সভায় যে চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো— বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রথম সংশোধিত প্রকল্প; দুটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ (সুন্দলপুর-৪ ও শ্রীকাইল-৫) ও দুটি অনুসন্ধান কূপ (সুন্দলপুর সাউথ-১ ও জামালপুর) প্রকল্প; তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প; এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প।
গত ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় একনেক সভা। ওই সভাতেও চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এতেও নতুন প্রকল্প ছিল দুটি, বাকি দুটি পুরনো প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ২৪ হাজার ৪১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে সাত হাজার ৭৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ থেকে ১৬ হাজার ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে আসবে ৬৫৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এ বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলো— সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২-এর অধীন এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প; cvজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটোরিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট; কালুরঘাটে কর্ণফুলি নদীর ওপর একটি রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্প; এবং মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প।
গত ২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় একনেক সভা। এতে পাঁচটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি নতুন, তিনটি পুরনো। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৬২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক হাজার ২৪২ কোটি ৮১ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ থেকে চার হাজার ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
এ বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলো— পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড টেওয়ার্কের পরিবর্ধন ও ক্ষমতাবর্ধন প্রকল্প; ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ইউনিভার্সিটিস ইন বাংলাদেশ টু প্রমোট ইউথ ইন্টারপার্টনারশিপ প্রকল্প; মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প; চট্টগ্রাম পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প; এবং ইমার্জেন্সি মাল্টি-সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স প্রজেক্ট।
সবশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এই সরকারের চতুর্থ একনেক সভা। ওই সভায় ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি প্রকল্প নতুন ও তিনটি পুরনো। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৭৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক হাজার ৬৪২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৩৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
এ বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে— চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, রাজিবপুর, রৌমারি ও নয়াহাট) নদী বন্দর নির্মাণ প্রকল্প; আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্প; কুমিল্লা অঞ্চলে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প; অর্থনৈতিকভাবে জীবনচক্র হারানো রাবার গাছ কর্তন, পুনরায় বাগান সৃজন ও রাবার প্রক্রিয়াকরণ আধুনিকায়ন প্রকল্প; ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্রের জন্য ৬০ এমএমএসসিএফডি সক্ষমতার প্রসেস প্ল্যান্ট সংগ্রহ ও স্থাপন প্রকল্প।
এই তালিকায় আরও রয়েছে রশিদপুর-১১ নম্বর কূপ খনন প্রকল্প; টুডি সিসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক ৭ অ্যান্ড ৯ প্রকল্প; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৬০টি ডে-কেয়ার সেন্টার প্রকল্প; বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটগুলোর পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন প্রকল্প; এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটগুলোর পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন প্রকল্প।
সারাবাংলা/জেজে/আরএস
অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়ন প্রকল্প একনেক সভা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ পরিকল্পনা উপদেষ্টা