সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট, বছরে বেড়েছে ১৪ শতাংশ
৩ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৪৯
ঢাকা: ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট চাল। খুচরায় সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা কেজিতে মিনিকেট বিক্রি হতে দেখা গেছে দোকানগুলোতে। এছাড়া বেশিরভাগ বাজার থেকেই এখন কেজিপ্রতি এই চাল কিনতে হচ্ছে ৮০ থেকে শুরু করে ৮৫ টাকার মধ্যে। যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, বছর ব্যবধানে নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। পাইজাম ও আটাশের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। টিসিবি’র হিসাবে এই তিন ধরনের চালের দাম বছর ব্যবধানে গড়ে বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
তবে বাস্তবে বাজার পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিজনক। বাস্তবে দাম বেড়েছে আরও বেশি। মিলার ও চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে কখনোই এত বেশি দামে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়নি। সামনে আরও দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত থেকে আরও বেশি চাল আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
নতুন বছরের প্রথম শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৮৬ টাকা, আটাশ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও বাসমতি ৯৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ আগেও মিনিকেট ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৭৮ টাকা, স্বর্ণা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও আটাশ ৫৮ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই প্রকারভেদে কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। আর প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
টিসিবির তথ্য মতে, শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সরু চালের মধ্যে নাজিরশাইল বা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৪ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ আগে দাম ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আর এক মাসে বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৮০ টাকায়। এক মাসে দাম বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। নাজির বা মিনিকেট গতবছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে। বছর ব্যবধানে নাজির বা মিনিকেটের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশে বেশি।
টিসিবির তথ্য বলছে, মাঝারি মানের চালের মধ্যে পাইজাম বা আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা কেজি। এক সপ্তাহ আগে ৫৬ থেকে ৬৩ টাকা ও এক মাস আগে এ জাতীয় চাল বিক্রি হয়েছে ৫৯ থেকে ৬৩ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ মাস ব্যবধানে এই চালের দাম বেড়েছে দশমিক ৮২ শতাংশ। তবে এক বছর আগে এ জাতীয় চাল বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। অর্থাৎ মধ্যমানের এই চালের দাম বছর ব্যবধানে বেড়েছে ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
টিসিবি সূত্রে জানা যায়, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা বা চায়না চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। এক সপ্তাহ, এমনকি এক মাস আগেও এ জাতীয় চালের দাম একই ছিল। তবে এক বছর আগে এই চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি। সেই হিসাবে বছর ব্যবধানে এ জাতীয় চালের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাতে ইব্রাহিমপুরের একটি মনিহারি দোকান থেকে ১২ কেজি মোজাম্মেলের মিনিকেট চাল ১ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন শাহিন মিয়া। ৮৫ টাকা কেজি দরে চালের দাম পড়ে ১০২০ টাকা। খুব পরিচিত হওয়ায় দোকানি তার কাছ থেকে ওই চালের দাম রাখে এক হাজার টাকা। শাহিন মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম এত বেশি কখনও দেখিনি। চালের বাজার আমাদের সব স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে।’ জানতে চাইলে ওই দোকানের কর্মচারী ফাহিম বলেন, ‘প্রতি বস্তায় চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। আমাদের কিছু করার নেই।’
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটেও একই চিত্র দেখা গেছে। বেশিরভাগ দোকানে মিনিকেট চাল ৮০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রিতারা সবধরনের চালের দাম বাড়ার তথ্য জানিয়েছেন। জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের চাটখিল রাইস এজেন্সির মালিক বেলাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে মিনিকেট চালের সরবরাহ কমেছে। করপোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে কি পরিমাণ চাল রয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। কয়েকবছর ধরে দেখছি, নতুন মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গেই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। অথচ বহুবছর ধরে নিয়ম ছিল, ধানের মৌসুম শেষে বাজারে চালের দাম কমবে। কিন্তু এখন হচ্ছে উল্টো।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলো ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বেশি দামে তা কিনতে শুরু করে। পরে মিলাররা আর কম দামে ধান কিনতে পারে না। আবার কোম্পানিগুলো চাল অনেকদিন মজুদ করে রাখতে পারে। যে করেপারেট কোম্পানিগুলো রয়েছে তারা চাইলে একাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা মনে হয়, এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এখন ভারত থেকে চাল আমদানি করছে। যেহেতু চাল আমদানি হচ্ছে, বাজারে তার প্রভাব পড়বে। তবে সরকারের আরও বেশি চাল আমদানি করা উচিত।’ মিনিকেটের দাম বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে কখনোই মিনিকেটের দাম এত বেশি বাড়েনি। এবার কেন জানি ব্যতিক্রম। ৮৫ টাকা কেজিতেও মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে। মাস খানেক আগেও ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়। অর্থাৎ মিনিকেটের বস্তায় দাম বেড়েছে ৪০০ টাকা। নাজিরশাইল চালের দামও একই রকম বেড়েছে।’
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের বাদশা রাইস এজেন্সির ম্যানেজার নূর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে এখন মিনিকেট ও নাজিরশাইলের দাম বেশি। মিনিকেট এক বস্তা (৫০ কেজি) এখন আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ টাকায়। এর পর আমাদের বিক্রি করতে হয়। বস্তায় এ জাতীয় চালের দাম বেড়েছে অন্তত ১০০ টাকা। ভারত থেকে চাল আসছে, তবে ভারতীয় মিনিকেট কেনাই পড়ছে ৭৭ টাকা। মিনিকেট এখন ৮০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। আটাশ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। মিনিকেটের মৌসুম না হওয়ায় এখন এই চালের দাম বেশি। নতুন নাজিরশাইল চালও বাজারে আসেনি। মিলগেট থেকেই আমাদের বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে।’
একই বাজারের মের্সাস জনপ্রিয় রাইছ এজেন্সির ম্যানেজার আমির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুনেছি গত সপ্তাহে ১০০ এর বেশি মিলারকে শোকজ করেছে সরকার। গত এক মাস ধরেই চালের দাম বাড়ছে। যে মিনিকেট আমরা ৭১ টাকায় বিক্রি করছি, এখন কিনে আনতেই ৭৮ টাকা পড়ছে। মিনিকেট চাল বাজারে আনতেই আমাদের খরচ পড়ছে ৮০ টাকা। আগের চাল থাকায় এখনো ৭৮ টাকায় বিক্রি করতে পারছি।’
বাজার এমন চড়া কেন? জানতে চাইলে নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বোরো মৌসুমের জিরা ও স্বর্ণা কাটা ধান থেকে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল হয়ে থাকে। বোরো মৌসুম শেষ হয়েছে ৮ থেকে ৯ মাস আগে। বোরো মৌসুমের যে ধান আগে আমরা ১৩০০ টাকা মণে কিনতে পেরেছি, এখন সেই ধান ১৯০০ টাকা মণেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিমণ ধানের দাম বেড়েছে প্রায় ৬০০ টাকা। মিলার ও কৃষক কারও কাছেই এ জাতীয় ধান সেই অর্থে তেমন নেই। এখন কোনো মিলারের কাছে যদি ২০০ মণ ধান চাওয়া হয়, তাহলে তা তাৎক্ষণিক দিতে পারবে না। কৃষকদের কাছ থেকে ৫ মণ বা ১০ মণ করে সংগ্রহ করে অন্তত দুই চার দিন পর সাপ্লাই দিতে হবে। ফলে বাজারে মিনিকেট ও নাজির চালের সরবরাহ কম, দামও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘তবে সবধরনের চালের দাম কিন্তু বাড়েনি। আমন মৌসুমে ওঠা ধানের চাল এখন সস্তা। স্বর্ণা, স্বর্ণা-৫, সুমন স্বর্ণা ও মানুন স্বর্ণা এখন সাশ্রয়ী দামেই বিক্রি হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ এখন ফেন্সি চাল খেতে চায়। কিন্তু ২৮ ও ২৯ ধানের চাল বাজারে সেই অর্থে কম। বোরো মৌসুমের ধান উঠতে আরও দুই/তিন মাস সময় লাগবে। তখন এসব চালের দাম কমবে। আগামী দুই তিন মাসে মিনিকেট ও নাজির চালের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।’
মিনিকেটের দাম নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘১৯৭৮ সাল থেকে আমি ধান চালের ব্যবসায় রয়েছি। ৪৫ বা ৫৬ বছরের ইতিহাসে কখনও দেখিনি, ধানের দামে ৬০০ টাকা পার্থক্য হয়। যে ধান মৌসুমের সময় কিনেছি ১৩০০ টাকা মণে, এখন সেই ধান ১৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’ যেহেতু বোরো মৌসুমের আরও দুই মাস বাকি রয়েছে, সেহেতু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম