ফিরে দেখা ২০২৪
আওয়ামী লীগের পতনে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:১২ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৫৪
ঢাকা: দীর্ঘ ১৫ বছরের ভয়াবহ দুঃশাসনের পর হঠাৎ তাসের ঘরের মতো আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেশবাসী- এমনটাই মনে করেন রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ। মামলা-হামলা আর নজিরবিহীন লুটপাটের পর দেশে যেন শান্তি ফিরে আসে। শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড়ধরনের পরিবর্তন আসে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একদিকে যেমন বন্ধ হয় লুটপাট, তেমনি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে রিজার্ভ। বন্ধ হয় যেমন গোপন কারাগার আয়না ঘর, তেমনি বন্ধ হয় গুম। এছাড়া বন্ধ হয়ে যায় হেলমেট বাহিনীর অত্যাচার ও সারাদেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। একদিকে যেমন বন্ধ হয় জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ, অন্যদিকে বন্ধ হয় পুলিশের দেদারছে চাঁদাবাজি। এভাবেই ঘুরে দাঁড়ানোর বছর ছিল ২০২৪।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দেশে এক তরফা জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতার মসনদে বসে। নতুন সরকারের ঠিক ছয় মাসের মাথায় শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে বাতিল হওয়া কোটা পুনরায় বহাল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে।
আন্দোলন চলাকালে ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করলে ওই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসের হলগুলোতে ফুসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার- স্লোগান তোলে শিক্ষার্থীরা।
এরপর ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন সারাদেশে নতুন মাত্রা পায়। এদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নব্য ‘রাজাকারদের’ দমানোর জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ঠ। অন্যদিকে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন তো চলছিলই। এদিন রাতে শুরু পুলিশের হয় ধরপাকড়।
১৬ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ হামলা করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাদের প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা গেছে। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্রলীগ ও পুলিশ গুলি করলে আবু সাঈদসহ পাঁচ শিক্ষার্থী নিহত হন। রংপুরে প্রথম শহিদ হন আবু সাঈদ। আবু সাঈদ বুক পেতে দিলে পুলিশ খুব কাছে থেকে গুলি করে। এর পর আন্দোলন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
১৮ ও ১৯ জুলাই সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামে শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করতে। ওইদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হলে ১৯ জুলাই রাতে সরকার সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই দিন রাতেই সেনা নামে ঢাকাসহ সারাদেশে।
সেনাবাহিনী ও বিজিবি নামানোর পরও আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের পাশাপাশি বিজিবিকেও গুলি করতে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মোহাম্মদপুরে গুলি ছোড়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর। র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়। এতে বাসার ভেতরে থাকা শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
নাহিদ-আসিফসহ কেন্দ্রীয় ৬ সমন্বয়ককে গোয়েন্দা সংস্থা পরিচয়ে তুলে যাওয়া হয়। এর পর তাদের বেধরক পিটিয়ে ৩০০ ফিট সড়কে রাতের অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হয়। নাহিদ আহত অবস্থায় রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘিরে রাখে। এরপর ২৯ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাহিদের নেতৃত্বে সমন্বয়করা।
সরকার সকল দাবি মেনে নেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোটা প্রথা বাতিল করে ৯৩ শতাংশ মেধাবী এবং বাকি ৭ শতাংশ অন্যান্য কোটা বহাল রাখে। ততদিনে গড়িয়েছে নানা পানি, ঘোলা হয়েছে সবকিছু। শহিদের রক্তে ততদিনে রাজপথ পিচ্ছিল হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের দাবির কোটা প্রথা বাতিল করা হলেও কয়েক মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রশ্নে অটল থাকে সরকার।
এ কারণে শিক্ষার্থীরা শুরু করে এক দফার আন্দোলন- শেখ হাসিনার পদত্যাগ। ১ আগস্ট নতুন কর্মসূচি আসে। একদিকে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে, অন্যদিকে আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে। ৩ আগস্ট নতুন কর্মসূচির আওতায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। শেখ হাসিনার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে থাকবেন। ৪ ও ৫ আগস্টের মধ্যে পদত্যাগ না করলে ৬ আগস্ট গণভবন ঘেরাও কর্মসূ্চি পালন করার ডাক দেওয়া হয়।
কিন্তু ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আসিফ মাহমুদ ঘোষণা করেন, এক দফার ঘেরাও কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নেওয়া হয়েছে। ঘেরাও কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান তিনি। ৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে সেনাবাহিনী রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করে। র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা বাড়ায়। বসায় মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড। বন্ধ করে দেওয়া হয় ঢাকাগামী সব বাস। আর ট্রেন এর আগে থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
৫ আগস্ট ভোর থেকে ঢাকার রাজপথ দখলে রাখে র্যাব, পুলিশ আনসার ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা। পথে পথে বেরিকেড বসিয়ে রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। আর আন্দোলনের মূল কেন্দ্রস্থল শাহবাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সকাল ৮টার দিকে খবর আসে যাত্রাবাড়ী থেকে শনিরআখড়া হয়ে সাইনবোর্ড পর্যন্ত কয়েক লাখ জনতা নেমে এসেছে সড়কে। অন্যদিকে সকাল ৯টার দিকে খবর আসে টঙ্গী এলাকায় প্রায় লাখ দুয়েক লোক জড়ো হয়েছে ঢাকায় প্রবেশের অপেক্ষায়। আর চাঁনখারপুল এলাকায় পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে বিপ্লবী জনতার।
বেলা ১১টার দিকে উত্তরা দিয়ে স্রোতের মত জনতা প্রবেশ করছিল গণভবনের দিকে। প্রায় একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশাল মিছাল এসে দখলে নেয় শাহবাগ। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সরে যায়। যাত্রাবাড়ী দিয়েও জনতার ঢল নামে। বেলা ১২টার দিকে শেখ হাসিনা পালানোর খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী জনতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। রাজপথে জনতার ঢল নামে। এ সময় সকলকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। ঢাকা শহরের রাজপথ হয়ে ওঠে জয়োল্লাসারের ধ্বনি। ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশেও আনন্দ মিছিল বের হয়। জেলায় শুরু হয় মিষ্টি বিতরণ। কেউ কেউ নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়াও আদায় করেন।
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেককেও ভারতে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। কেউ পালাতে গিয়ে সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক হয়। কেউ আবার বিমানবন্দর দিয়ে পালানোর সময় গ্রেফতার হন। অবশেষে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম