রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করা আমলা ও সিবিএ নেতাদের বিচার দাবি
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৬ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:২৮
ঢাকা: সরকারের আমলা ও সিবিএ নেতাদের যোগসাজশে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অবাধে লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটি। এসব লুটপাটে অভিযুক্ত সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে তারা।
নাগরিক সমন্বয় কমিটির নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের দায়ে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারাসহ অন্যান্য ধারায় ফৌজদারি মামলা হতে হবে। সব অভিযুক্ত আমলা, সিবিএ নেতাসহ দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটি এ দাবি তুলেছে। ‘রংপুর চিনিকল চালু করার নামে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে’ এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে রংপুর চিনিকল পুনরায় চালু প্রসঙ্গে বলা হয়, গোবিন্দগঞ্জে রিকুইজিশন করা জমি আখ চাষের নামে নেওয়া হলেও বিগত প্রায় দুই দশক ওই কাজে ব্যবহৃত হয়নি। তাই তিন ফসলি এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর কৃষিজমি মূল সাঁওতাল আদিবাসী মালিকদের উত্তরাধিকারী ও তাদের পরিবার পরিজন এবং অন্যান্য আদি-বাঙালি কৃষক পরিবারের কাছে অবিলম্বে হস্তান্তর করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো গড়িমসি করা যাবে না।
‘রাষ্ট্রায়ত্ত বন্ধ হওয়া চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই’— এমন দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে সরকারি চিনিকলের সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে তিনটি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে ও তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়েছে। তবে এই ১৫টির মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ৯টি। ‘আখের সংকট ও লোকসানে’র কারণ দেখিয়ে কয়েক বছর আগে বাকিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে এ চিনিকলগুলো কার্যত আগে থেকেই ধুঁকে ধুঁকে চলছিল কিংবা এক রকম বন্ধই হয়ে ছিল।
দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা কমপক্ষে ২২ লাখ টন এবং কাগজে-কলমে সরকারি চিনিকলগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন এক লাখ টনেরও কম উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, এর অর্থ হচ্ছে— চিনিকলগুলো পুরোপুরি চালু করলেও চিনির বার্ষিক চাহিদার মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বাকি সাড়ে ৯৫ শতাংশ আমদানি বা বেসরকারি চিনি পরিশোধনকারী কারখানাগুলো থেকেই আসবে। আর সরকারি মিলের উৎপাদিত চিনির দাম বাজারের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার কারণে তা বিক্রিও হয় না, গুদামেই পড়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে বন্ধ হওয়া চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর ধারাবাহিক লোকসানের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সরকারি চিনিকলগুলো ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর লোকসানের পরিমাণ গড়ে ৮৩০ কোটি টাকার বেশি। কোনো কোনো বছর এই লোকসানের টাকা হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে সরকারি চিনিকলগুলোর বিপুল লোকসানের মূল কারণ চিনিকল কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, পুরোনো যন্ত্রপাতি এবং সর্বোপরি নানা গোষ্ঠীর মিলিত লুটপাট।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—
- বন্ধ চিনিকলগুলো চালু করা আদৌ লাভজনক কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করতে হবে। তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ বিবেচনায় নিয়েই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে;
- সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পেছনের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে;
- তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে;
- চিনিকল চালুর জন্য গঠিত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলানির্ভর টাস্কফোর্স বাতিল করে রুগ্ন, মুমূর্ষু ও দেনার দায়ে জর্জরিত চিনিকলের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে সংস্কার বা প্রতিস্থাপন করে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদার নিরিখে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন কীভাবে ঘটানো যায়, তার প্রস্তাবনার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে;
- গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের রিকুইজিশন করা জমি আখ চাষের নামে নেওয়া হলেও প্রায় দুই দশক ওই কাজে ব্যবহৃত হয় না। তাই তিন ফসলি এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর কৃষিজমি মূল সাঁওতাল আদিবাসী মালিকদের উত্তরাধিকারী ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং অন্যান্য আদি-বাঙালি কৃষক পরিবারের কাছে অবিলম্বে হস্তান্তর করতে হবে;
- ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লিতে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী ও লুটপাটকারী পুলিশের একাংশসহ অভিযুক্ত সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; এবং
- ওই দিন গোবিন্দগঞ্জে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যার আয়োজনের সঙ্গে স্থানীয় স্বৈরশাসকদের দোসর সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ এবং চিনিকল ম্যানেজার আব্দুল আউয়াল জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার ও শাস্তি দিতে হবে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/আরএস