অনিশ্চয়তা কেটে গেছে
ফের শুরু হবে চিলমারী বন্দর উন্নয়নের কাজ
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৩:৩২
ঢাকা: অবশেষে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেল কুড়িগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী চিলমারী নদী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প। শুরু থেকেই এ প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ছিল ধীর। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে এর প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়। অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রস্তাবটি ফেরত পাঠানো হলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল এর ভবিষ্যৎ।
সেই অনিশ্চয়তা শেষ পর্যন্ত কেটে গেছে। প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পুনরায় কমিশনে পাঠানো হলে গুরুত্ব বিবেচনায় গত সোমবার এটি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। শুধু তাই নয়, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশও দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। ফলে আশার আলো দেখা দিয়েছে উত্তরের অবহেলিত জনপদে।
প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের পর একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘদিন ধরে এ প্রকল্পের কাজ হচ্ছিল না। আমরা জনগণের কথা বিবেচনা করে এটি খুঁজে বের করেছি। আশা করছি, এখন এটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব কাজ করার কথা ছিল, সেগুলো করা হয়নি। জমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন, আরসিসি জেটি ও অ্যাকসেস ব্রিজ নির্মাণ, আরসিসি পেভমেন্ট, তীর রক্ষা ও ড্রেজিংয়ের কাজ— কোনোটিই হয়নি। বিশেষ করে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে।’
একেনেক অংশ নেওয়া দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, একনেক বৈঠকে একজন উপদেষ্টাসহ অনেকেই চিলমারী নদীবন্দর প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরেন। বিশেষ করে কুড়িগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যেটি ভুটান সরকার করবে বলে এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, ভুটান এই অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করলে চিলমারী নদী বন্দরটি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। ফলে মালামাল পরিবহণ অনেক সহজ হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ‘চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, রাজিবপুর, রৌমারী, নয়ারহাট) নদী বন্দর নির্মাণ’ প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পে খরচ হয়েছে মাত্র সাত কোটি ৭৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, বাস্তব অগ্রগতি ৮ শতাংশ।
এদিকে, অনুমোদনের সময় প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর আগে একবার ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় নৌপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত হবে। পাশাপাশি নৌবাণিজ্য ও অতিক্রমণ প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়নে অন্যতম কেন্দ্র হতে পারে।
চিলমারী বন্দরটি কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। এর অবস্থান জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। চিলমারীর রমনা রেলস্টেশন থেকে ৫০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এ বন্দর এক সময় কৃষিপণ্য বেচাকেনা এবং যাত্রী ও মালামাল পরিবহণের অন্যতম প্রধান স্থানীয় বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। এ বন্দরের প্রধান সুবিধা হচ্ছে— ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমর, ফুলকুমর ও জিনজিরামসহ প্রায় ১৫টি নদীর সংযোগস্থলে এটি অবস্থিত।
ইতিহাস বলছে, একসময় অবিভক্ত ভারতের আসামের ধুবরী, গৌহাটি ও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকেও এখানে জলযান নোঙর করত। এখানে ছিল কাস্টম স্টেশনও। পরে দেশ ভাগ ও যমুনা নদীর ভাঙনে দিনে দিনে এ বন্দরের গুরুত্ব কমে যায়। তবে এখনো এ বন্দর এলাকা দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ যাত্রী যতায়াত করেন। বিভিন্ন উৎসবে যাত্রীর পরিমাণ বেড়ে দেড় হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের তথ্য, এখন কেবল চিলমারী ও রৌমারীর মধ্যে প্রতিদিন আট থেকে ৯টি বড় জলযান চলাচল করছে। চিলমারী ও রাজিবপুরের মধ্যেও চলাচল করে কয়েকটি জলযান। এ ছাড়া ৭০ থেকে ৮০ টন মালামাল প্রতিদিন এই বন্দরে ওঠানামা করে। বর্ষাকালে বন্দরের ব্যবহার বেড়ে যায় বহু গুণ। ধান, চাল, গম ইত্যাদি পণ্য দেশের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে পরিবহণ করা হয়। পাট, পাটশলা, দেশলাইয়ের কাঁচামাল তুলা কাঠও এ বন্দর দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহণ করা হচ্ছে। বুড়িমারী ও সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পাথর চিলমারীর রমনা ও ফকিরহাট হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবাহিত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে বন্দর উন্নয়নে প্রকল্পটি হাতে নেয় নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কিছু নতুন অঙ্গের অন্তর্ভুক্তি, রেট শিডিউল পরিবর্তন, বিভিন্ন কাজের পরিমাণ ও ব্যয় বাড়া ও কমার কারণে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের সংশোধনীর প্রস্তাব পাঠানোর পর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন বিভিন্ন সুপারিশ দেওয়া হয়। সেগুলো প্রতিপালন করে সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ফের কমিশনে পাঠায় নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য একনেকের বৈঠকে উপস্থাপনের অনুমতি চাওয়া হয় পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে।
প্রায় এক মাস সেখানে পড়ে থাকার পর উপদেষ্টার দফতর থেকে সংশোধনী প্রস্তাব ফেরত পাঠানো হয় কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে। এরপর প্রকল্পের যৌক্তিকতা আছে কি না, তা আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেয় কমিশন। পরে আবারও মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে আরডিপিপি পাঠানো হয়। এবারে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা এটি একনেকে উপস্থাপনের অনুমতি দেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/জেজে/আরএস